যাই হোক, বাবার মগজে চেপে বসে আছে বিশ্বনাথ যাজ্ঞিক। তার সঙ্কল্প, ফুরসত মতো বিয়েটা দিয়ে দেবেন। আর তারপরেও মেয়ে-জামাই চোখের আড়াল হবে না। এখানেই থাকবে তারা। সঙ্কল্পের কথা বাবা মুখ ফুটে কখনো বলে নি অবশ্য। অন্তত, এখন পর্যন্ত যশোমতী নিজের কানে বলতে শোনে নি। কিন্তু বাবার মনে কি আছে বোঝা একটুও কঠিন নয়।
দাদা আলাদা বাড়িতে আছে বলেই তার সঙ্গে প্রীতি এবং সন্তাব সম্পূর্ণ বজায় আছে। সে নিয়মিত আসে, বাবা-মায়ের খোঁজখবর করে। খোঁজ-খবরটা যশোমতীর আরো বেশি নিতে শুরু করেছে ইদানীং–সোজা তার কাছেই আসে, গল্প করে। যশোমতী এবং তার মায়েরও ছেলের বাড়িতে যাওয়া-আসা আসে। এই হৃদ্যতার ফলেই বোনের ওপর কিছুটা জোর আছে ধরে নিয়েছিল দাদা। মনে মনে তাই যশোমতীর জন্যে সে-ও একটি পাত্র স্থির করে বসে আছে। অবশ্য নিজের তাগিদে করে নি, করেছে স্ত্রীর তাগিদে–আর শ্যালকের তাগিদে। শুধু শ্যালক নয়, শ্যালক বন্ধুও বলা যেতে পারে।
এই শ্যালকটি স্বয়ং দ্বিতীয় পাত্রবীরেন্দ্র যোশী। দাদার নিজের শ্যালক, অর্থাৎ বউদির ভাই। দাদার থেকে বছর দুই ছোট হলেও তারা পরস্পরের গুণমুগ্ধ ভক্ত। দাদার ব্যবসায়ের সে ডান হাত। বিশ্বনাথ যাজ্ঞিক বাবার যেমন ডান হাত, সে-রকম নয়। তার থেকে অনেক বেশি। বাবার ধারণা, ডান হাত দিয়ে সে আর একটি ডান হাত গড়ে তুলেছে, কিন্তু দাদার বিশ্বাস এই শ্যালক বন্ধুর একাগ্র নিষ্ঠা আর পরিশ্রমের ফলেই তার ব্যবসা এমন চট করে ফুলে ফেঁপে উঠতে পেরেছে।
যশোমতী ধরেই নিয়েছে তাকে বিয়ে করার ইচ্ছেটা সে-ই সঙ্গোপনে দাদার কাছে প্রকাশ করেছে। আর তারপর দাদা-বউদি মেতে উঠেছে। এই মাতামাতিটা আজকাল একটু বেশিই করেছে তারা। দাদার বাড়ি গেলেই তার দেখা অবধারিত মিলবে। বউদিই হয়তো আগে থাকতে খবর দিয়ে রাখে ভাইকে। বীরেন্দ্র যোশর ইচ্ছেটা তার হাব-ভাবে অনেক আগেই যশোমতী বুঝে নিয়েছিল। তার দিক থেকে উৎসাহ বোধ করার মত কোনরকম সদয় আভাস না পেয়ে শেষে দাদাকে মুরুবি পাকড়েছে। লোকটির প্রতি দাদা, এত নির্ভরশীল যে হয়তো তাকে আশ্বাসই দিয়ে বসেছে, কিছু ভাবনা নেই, ব্যবস্থা হবে।
যখন-তখন দাদা তার শ্যালক-বন্ধুকে নিয়ে এ বাড়িতে হানা দিচ্ছে আজকাল। পরম স্নেহভরে হাঁকডাক করে বোনকে ডাকে। আর ফাঁক পেলেই বন্ধুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। ছদ্ম বিস্ময়ে যশোমতী এক একসময় হাঁ করে চেয়েই থাকে বীরেন্দ্র যোশীর দিকে–অর্থাৎ এত গুণ কোনো এক মানুষের থাকে সেই বিস্ময়েই যেন তার চোখের পলক পড়ে না।
আনন্দে পুলকে বীরেন্দ্র যোশী ঘামতেই থাকে বোধহয়। এখানে বিয়ে হলে এই দিকের বিশাল সম্পত্তিও নিজেদের মধ্যেই থেকে গেল ….দাদার কানে বউদির এই মন্ত্র ঢোকানও বিচিত্র নয়।
কিন্তু এই পাত্রও যে আদৌ পছন্দ নয়, সে শুধু যশোমতীই জানে।
মায়ের হাতেও তার বিশেষ পছন্দের পাত্র আছে একটি। তৃতীয় ক্যাণ্ডিডেট। রমেশ চতুর্বেদী। বড় মিল-মালিকের ছেলে সে-ও। রমেশ চতুর্বেদীর মায়ের সঙ্গে যশোমতীর মা কমলা দেবীর ইদানীং খুব ভাব। ভাবের সমস্ত রাস্তা রমেশের মা-ই প্রসারিত করেছে। সেটা ছেলের মুখ চেয়ে। রমণীমহলে মহিলাটি কমলা দেবীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে চেষ্টা করা দূরে থাক, উন্টে তাঁর কথায় সর্বদা সায় দিয়ে চলে। মায়ের বিচারবিবেচনা বুদ্ধির প্রশংসা তার মুখে যত, আর কারো মুখে তত নয়। আর ছেলের তো কথাই নেই, মাসি বলতে অজ্ঞান। সে যে অনুষ্ঠানের মাতব্বর, মাসি অর্থাৎ যশোমতীর মায়ের সেখানে সর্বাগ্রগণ্য মর্যাদা। যশোমতী দেখে আর হাসে আর ভাবে এমন ভাবী শাশুড়ী ভক্ত মানুষ সচরাচর দেখা যায় না বটে।
অতএব মায়ের মতে রমেশ চতুর্বেদী হীরের টুকরো ছেলে। বিয়ে না হতেই যে ছেলে তাকে এতটা মর্যাদা দেয়, বিয়ে হলে সে কি করবে? অভিজাত মহলে একটু বিশেষভাবেই গণমান্য হয়ে ওঠার ইচ্ছেটা মায়ের একটু বেশিই। তার ধারণা জামাই হলে রমেশ এ ব্যাপারে সকলের থেকে কাজের হবে। বছরে দু’তিনটে বড় ফাংশানের মাতববর সে বটেই, তার জামাই হলে ভবিষ্যৎটা আরো উজ্জ্বল তো হবেই। যশোমতী মায়ের বাসনা বুঝে মনে মনেই শুধু হাসে, বাইরে নির্বোধের মতো থাকে। কারণ, তার বিবেচনায় রমেশ চতুর্বেদীও বাতিল। কেন বাতিল, সেটা অত তলিয়ে ভাবে নি, নির্বাচনটা মায়ের বলেই হয়তো নির্দ্ধিধায় বাতিল।
সকলকে বাদ দিলেও ক্যাণ্ডিডেট তার নিজের হেপাজতেও জনা দুই অন্তত আছে। প্রত্যাশীর সংখ্যা তার ঢের বেশি, কিন্তু তাদের মধ্যে এই দু’জন আর কোনো সুপারিশের ওপর নির্ভর না করে বুদ্ধি মানের মতো নিজেরাই এগিয়ে আসতে চেষ্টা করছে। শিবজী আর ত্রিবিক্রম। এরাও মস্ত ঘরের ছেলে। কুল-মান-যশে কারো থেকে ফেলনা নয়। অন্যদের মতোই রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে। লেখা-পড়ায় তো ভালই আবার পাঁচ কাজে চটকদার উদ্ভাবনী শক্তিও আছে। বিশ্বনাথ বাবার মুখ চেয়ে আছে, রমেশ চতুর্বেদী মায়ের আর বরেন্দ্র যোশী দাদার। এদের তুলনায় শিবজীর চালচলন শিবজীর মতোই সুতৎপর, আর ত্রিবিক্রমের রসিকতার বিক্রম অন্তত তিনগুণ বটে। এই দুজনের একজনকেই যে একেবারে স্বতঃসিদ্ধভাবে গ্রহণ করে বসে আছে যশোমতী, এমন নয় আদৌ। তবে ঘরের কল্পনা যদি কখনো-সখনো করতে হয়, এই দুজনের একজনকে নিয়েই করতে চেষ্টা করেছে। কখনো ভাল লাগে নি, কখনো বা একেবারে মন্দ মনে হয় নি। তবে অন্য সকলের থেকে এই দুজনের প্রতি যশোমতীর একটু অনুকম্পা বেশি, কারণ, তারা শুধু তারই ওপর নির্ভর করে আসছে। তাদের সুপারিশ সরাসরি তারই কাছে।