তবু স্ত্রীর সঙ্গে যে এক একসময় ঝগড়া বেধে যেত, তার একটা কারণ আছে। কমলাদেবী মহিলাটি একেবারে যে নির্বোধ তা নয়। কিন্তু স্বামীর বুদ্ধি আর চিন্তার সঙ্গে তাল রেখে চলা সত্যিই কঠিন ব্যাপার। অথচ এমন একজনের ঘরণী সে, সর্বদা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেই বা কি করে। নিজের যথাযোগ্য মর্যাদা বজায় রাখতে গিয়ে, অর্থাৎ সমান তালে বুদ্ধি আর চিন্তা খাটাতে গিয়েই যত গণ্ডগোল। মহিলা এমন কাণ্ড করে বসে এক-একসময়, বা এমন কিছু বলে যে মেজাজ ঠাণ্ডা রাখা দায়। বাইরের অনেক আচার-অনুষ্ঠানে শুধু মাত্র স্ত্রীর মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়েই ভদ্রলোকের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। আর তাই নিয়েই তুমুল হয়ে যায় এক-একদিন।
বাবা-মায়ের এই ঝগড়াঝাটি যশোমতী বেশ উপভোগ করে। মায়ের হেনস্থা দেখে তার স্বাধীনচেতা মন এক এক সময় ভ্রুকুটি করে ওঠে। আবার বয়স্কদের ছেলেমানুষী দেখে হেসে গড়ায়। তবু, বাইরের দিক থেকে বাবার চেয়েও মায়ের ওপরেই তার টান বেশি। তার কারণ, বাবার মেজাজ যে তার নিজেরও। ফলে, মেজাজ যে বেশি দেখায় তার ওপরেই তার মেজাজ চড়তে চায়।
কিন্তু বাড়িতে একদিন গণ্ডগোল পাকিয়ে উঠল যশোমতীকে নিয়েই। অর্থাৎ, তার বিয়ে নিয়ে। যশোমতী তখন এম-এ পড়ছে। যশোমতী ততদিনে মেয়েদের ক্লাব করেছে। যশোমতী ততদিনে অনেক আসরে গানের খ্যাতি কুড়িয়েছে। যশোমতী এমন অনেক কিছু করেছে যা তার বয়সে কেউ কখনো কল্পনাও করেনি। ফলে যশোমতী তখন নিজের থেকে বেশি বুদ্ধিমতী আর কাউকে মনে করে না।
কিন্তু তার বিয়ে নিয়ে বাড়িতে বাবা-মায়ের একটা বিবাদের প্রহসন অনেকদিন ধরেই তলায় তলায় জমাট বেঁধে আসছিল। যশোমতী তা লক্ষ্য করত আর উপভোগ করত। বাবা-মা আর দাদার ত্রিমুখী ধারা দেখে তার বেশ মজাই লাগত। বাবা কারো সঙ্গে পরামর্শ করার মানুষ নয়। তার সব থেকে প্রিয়পাত্র গোফওলা বিশ্বনাথ যাজ্ঞিক। চোখে পড়ার মতো প্রশ্রয় বাবা সচরাচর কাউকে দেয় না। কিন্তু বিশ্বনাথের ব্যাপারে তার পক্ষপাতিত্ব যশোমতীর চোখে অন্তত পড়ত। বাড়ির যে-কোনো অনুষ্ঠানে ওকে নেমন্তন্ন করা চাই। কোথাও বেড়াতে যাওয়া হবে ঠিক হলে বাবা তক্ষুনি বলবে, বিশ্বনাথকে খবর দেওয়া যাক, ও সঙ্গে থাকলে নিশ্চিন্তি।
যশোমতীর মতেও হয়তো লোকটা খুব মন্দ নয়, অনেক ব্যাপারে তার খুঁত ধরতে চেষ্টা করেও সামনাসামনি বিরূপ হবার মতো কোনো বড় গোছের ত্রুটি দেখতে পায় নি। তার ওপর লোকটা ধীর-স্থির বিনয়ী স্বল্পভাষী। বাড়িতে সর্বদাই যাওয়া-আসা। কিন্তু ওই গোঁফ চক্ষুশূল যশোমতীর। সে মুখের কথা খসালেই বিশ্বনাথ গোঁফ নিমূল করে ফেলবে, তাতে অবশ্য কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সে বলতে যাবে কেন? ওই গোফ থেকেই ভিতরের রুচি বোঝা যায়। আসলে গোঁফের এই ত্রুটি আবিষ্কার যে উপলক্ষ মাত্র, যশোমতী নিজেও তা ভালো জানে না। ছেলেটার আসল অপরাধ, সে তার বাবার নির্বাচিত ব্যক্তি। বাবার ব্যবস্থা নাকচ করে দেবার মতো সাবালিকাত্ব যশোমতী অর্জন করেছে। বাবার আদরের মানুষ বলেই তার ওপর রাগ। বাপকে বশ করে যে মেয়ে ধরতে চায়, তার দিকে তাকাতেও রাজি নয় যশোমতী।
অথচ বাবার দুনিয়ায় এক মাত্র বিশ্বনাথই তার মেয়ের যোগ্য ছেলের মতো ছেলে। বাবার এক-নম্বর সেক্রেটারী। বাবার সঙ্গে বার-দুই বিলেত ঘুরে এসেছে। সৎ ব্রাহ্মণবংশের ছেলে। বনেদী বড় ঘর। কর্মঠ। এরই মধ্যে ব্যবসার নাড়ী-নক্ষত্র সব বুঝে নিয়েছে। তাদের নিজেদের বাড়িতে টাকার ছড়াছড়ি, শুধু বাবার আকর্ষণেই নাকি এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে। দরকার পড়লে এই এতবড় ব্যবসাটা সে নিজের হাতে চালাতে পারে এখন, এই বিশ্বাসও বাবার বদ্ধমূল।
আর সেই দরকার একদিন-না-একদিন তো পড়বেই। কারণ, ক’বছর আগেই দাদার জন্য বিরাট একটা আলাদা মিল কিনেছে বাবা। সেই মিলের একচ্ছত্র মালিক দাদা। দাদা সেটা চালাচ্ছে এখন। বাবা তাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছে, নিজের মিল যত পারে বড় করে তুলুক–বাপের মিলের কোনো অংশ সে যেন আশা না করে। অর্থাৎ বাবার অবর্তমানে এই মিলের মালিক হবে মেয়ে। এই থেকেই মেয়ের প্রতি বাপের প্রচ্ছন্ন পক্ষপাতিত্বটুকু বোঝা যাবার কথা। কিন্তু তখন বোঝার মতো চোখ কারো ছিল না। যশোমতীর তো ছিলই না, কারণ, ব্যবসা চালানোর ব্যাপারে বিশ্বনাথের মুখাপেক্ষী না হলে অথৈ জলে হাবু-ডুবু খেতে হবে মেয়েকে–বাবার এই ধারণার বিরুদ্ধেই যশোমতী মনে মনে ভ্রুকুটি করে এসেছে সর্বদা।
যাই হোক, নিজের মিল বাবার সাহায্যে দাদা ভালই দাঁড় করিয়েছে। দাদা বয়সে সাত-আট বছরের বড় যশোমতীর থেকে। দাদাটি বিয়ে করেছিল বাইশ বছর বয়সে। মস্ত বড় ঘরেই বিয়ে হয়েছিল তার। স্বভাবতই এই ভ্রাতৃবধুটিও বড় ঘরের মেজাজ নিয়েই এসেছিল এ-বাড়িতে। প্রথম দু’চার বছর ইচ্ছেয় হোক আর অনিচ্ছেয় হোক সে মানিয়ে চলেছে। তার পরেই তার হাব-ভাব চাল-চলন বাপের বাড়ির ধারায় বদলাতে শুরু করল। এক পরিবারে দুই কত্রীর আধিপত্য টেকে না। মায়ের সঙ্গে বউয়ের একটু-আধটু মনকষাকষির সূত্রপাতেই দাদার আলাদা বাড়ি হয়েছে। ভালো জমি বাবা আগেই কিনে রেখেছিল, দাদার বাসনা বুঝে বাড়িও বাবাই তুলে দিয়েছে। সেই বাড়িতে সর্বাধুনিক হাল-ফ্যাশনের ব্যবস্থাগুলো শুধু দাদার টাকায় হয়েছে। অতএব ষোল বছর বয়স না হতেই যশোমতী জানে, বাবার এই বাড়ির একচ্ছত্র ভাবী মালিক সে-ই।