হৃদয়ের কথা এমনি কোনো সত্যেরই প্রতীক হয়তো।
কিন্তু হৃদয়ের ঠিক এই কথার জাল বিস্তারের আগ্রহ নিয়ে আমি এই সাবরমতীর দেশে আসিনি। বস্তুত, এখানে আসার পিছনে উদ্দেশ্য বলতে কিছু ছিল না। উপলক্ষ ছিল। সেও নিতান্ত গতানুগতিক। উপলক্ষ সাহিত্য-সম্মেলন। উদ্যোক্তারা বাংলার বাইরে এ-ধরনের সম্মেলনের আসর সাজানোর ফলে বহু সাহিত্যরসিক কাব্যরসিক নাট্যরসিকের সমাবেশ ঘটে। এই সমাবেশের পিছনেও সাহিত্যরসাহরণ প্রধান আকর্ষণ কিনা সঠিক বলতে পারব না। আমার দিক থেকে অন্তত আরো গোটাকতক জোরালো আকর্ষণ আছে। কোথাও থেকে আমন্ত্রণ এলেই সিঙ্গল ফেয়ার ডাবল জার্নির হাতছানিটা প্রথম চোখে ভাসে। দ্বিতীয়, সম্মেলনের চার-পাঁচটা দিন কোথাও রাজ-অভ্যর্থনা, কোথাও রাজসিক। বলা বাহুল্য, এটা নি-খরচায়। তৃতীয়, নতুন জায়গা দেখার সুযোগ।
তবু গুজরাটের এ-হেন জায়গায় বাংলা সাহিত্য অধিবেশনের ব্যবস্থার কথা শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম। শুনেছিলাম, এই রাজ্যের ছেলেমেয়েরা প্রথম জ্ঞান-উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা বুঝতে শেখে। এই দেশ লক্ষ্মীর চলা-ফেরার একেবারে সদর রাস্তা। ভারতের সব রাজ্যে বিত্তবানের সংখ্যা কিছু আছেই–কিন্তু এখানকার মতো আর কোথাও নেই নাকি। ছেলেবেলায় ভুগোল বইয়ে পড়েছিলাম বস্ত্র-শিল্পে গোটা ভারতের মুখ উজ্জ্বল করে রেখেছে এই একটি জায়গা। এই দেশ বলতে আমার চোখে শুধু ভাসত তুলোর চাষ, তুলোর গাছ, সুতোর কল, আর কাপড়ের কল।
অবশ্য এই ধারণার সবটাই অজ্ঞতা-প্রসূত। জানার তাগিদ থাকলে অনেক জানা যেত। একেবারে যে কিছুই জানতুম না তাও নয়। কিন্তু সেটা ভাসা-ভাসা জানা। শরতের হালকা মেঘের মতো একটা অগভীর ধারণা শুধু মনের আনাচে-কানাচে ভাসছিল। এখানে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে তার অনেকটাই সরে গেছে। শহরের বুকের ওপরেই সুতোর কল আর কাপড়ের কল অনেক আছে বটে। কিন্তু তুলোর চাষ, তুলোর গাছ নেই। তুলো আসে অনেক দূর থেকে। আসে পশ্চিমঘাট উপত্যকার সমতল ভূমি সহ্যাদ্রির কালো মাটির অঞ্চল থেকে, আর বহু দূরের সাতপুরা হিলস থেকে।
এখানে এসে প্রথম যে জিনিসটি ভাল লেগেছিল, তা এখানকার মানুষদের অন্তরঙ্গ আতিথেয়তা, অমায়িক অথচ সহজ সৌজন্যবোধ। এযাবৎ বিত্তবানের দু’রকমের আতিথ্য লাভের সুযোগ ঘটেছে। এক, খানদানী আতিথ্য। সেখানে গৃহস্বামী আর অতিথি যত কাছে আসে ততো ব্যবধান বাড়ে। তাদের আতিথ্যের চটকের সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে হাঁপ ধরে আর ভিতরের এক ধরনের দৈন্য নিভৃতের নানা জটিলতার বিবরে আত্মগোপন করতে চায়। দ্বিতীয় পর্যায়ের আতিথেয়তা নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ তুষ্টির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেবার মতো। উদ্বেগ নেই, মান খোয়া যাবার শঙ্কা নেই, হিসেব করে পা ফেলে চলার অদৃশ্য তাগিদ নেই। ঐশ্বর্য সেখানে চোখের ওপর সরাসরি সূর্যের আলো ফেলে দৃষ্টি অন্ধ করে না। উদয়ের প্রথম অথবা অস্তের শেষ আভার মত স্নিগ্ধ স্পর্শ ছড়ায়। স্মৃতিপটে সেটুকু লেগে থাকে। বিত্তবান ব্যক্তিবিশেষের এ-রকম আতিথ্য বেশি না জুটলেও জুটেছে। কিন্তু সমবেত বিপুল অভ্যাগতসমষ্টির প্রতি এখানকার সামগ্রিক আতিথ্যের রূপটাই এই দ্বিতীয় পর্যায়ের। এই জায়গাটার সম্পর্কে আগের ধারণা বা অজ্ঞতার জন্য মনে মনে নিজেই লজ্জা পেয়েছি। বিত্ত যেখানে প্রসন্ন দৃষ্টি ফেলে তার রূপ আলাদা।
শুকনো বাদামী বালির দেশ। কিছুটা টানের জায়গা। অঙ্কের হিসেবে মরুভূমির দূরত্ব এখান থেকে খুব দুস্তর নয়। কিন্তু মরুভূমি এখানকার কোনো কিছুতে টান ধরাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। একটা ভৌগোলিক অস্তিত্ব নিয়ে কোনো এক পাশে পড়ে আছে যেন। এখানকার মানসিকতা থেকে মরুভূমি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।
তার কারণ বোধহয় এখানকার হৃৎপিণ্ডের ওপর দিয়ে বইছে সাবরমতী। শহরের প্রায় মাঝখান দিয়ে গেছে। তার দু’কুলে শহর। একই শহর। স্বভাবতই মাঝে মাঝে সেতুবন্ধ চোখে পড়বে। মনে হয়, এই নদীর সঙ্গেই এখানকার মানুষদের নাড়ীর যোগ। জন্মের পর চোখ খুলেই যারা নদী দেখে তাদের সত্তাও সেইভাবেই পুষ্ট হয় বলে বিশ্বাস। এখানকার মানুষদের আমোদ প্রমোদ ধর্মাচরণ অনেকটাই এই নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। ছিল বলি কেন, আজও নেই এ-কথা জোর করে বলতে পারিনে। দিন বদলেছে বলে হয়তো ধারা বদলেছে কিছুটা। পুরনোর উপর নতুনের আলো সর্বত্র যেমন পড়ে তেমনি পড়েছে। কিন্তু সেটা বহিরঙ্গের ব্যাপার।
দেশের সতেরোটি পবিত্র স্থানের মধ্যে বেশির ভাগেরই অস্তিত্ব এই সাবরমতীর তীরে। চোখে দেখিনি, গল্প শুনেছি–তিন বছর অন্তর মলমাসের উৎসবানুষ্ঠানে আজও হাজার হাজার রমণী খালি পায়ে এই সব পবিত্র স্থানে উপসনান্তে নগর-প্রদক্ষিণ করে। অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত সংস্কারান্ধ গরিব ঘরের মেয়ে নয় সকলেই। গরিবের সংখ্যা এমনিতেই কম এখানে, শিক্ষারও দ্রুত বিস্তার ঘটছে। রমণীদের বিশ্বাস তারা নগর প্রদক্ষিণ করলে নগরের কল্যাণ হবে। কেন হবে তা তারা জানে না বা জানতে চেষ্টাও করে না। শিক্ষার গর্ব বা বিত্তের ছটা প্রাচীন বিশ্বাসের শিকড় কেটে দেয়নি। কল্যাণ হোক না হোক কল্যাণ তারা চায় এটাই বড় কথা। নগর প্রদক্ষিণের এ-দৃশ্য স্বচক্ষে না দেখলেও নদীর ধারের আর এক উৎসব প্রত্যক্ষ করেছি। কার্তিকের শুক্লা-একাদশীর মেলা। শুধু মেলা দেখলে হয়তো এমন কিছু বৈচিত্র্য চোখে পড়বে না। বহু দর্শনার্থী বহু জন-সমাগম বহু পণ্যের চিরাচরিত দৃশ্য। কিন্তু মেলার অদৃশ্য মানসিকতাটুকু মনোগ্রাহী। দেবোত্থান একাদশীর মেলা–দেব-উঠি-আগিয়ারস্।