সেদিনের সেই যশোমতীকে নিয়ে কল্পনার অভিসারে গা ভাসায়নি শহরের অভিজাত ঘরের বয়সকালের এমন একটি ছেলেও ছিল কিনা সন্দেহ। সেই রোমান্স নিয়ে যে বড় রকমের হৃদয়বিদারক অঘটন কিছু ঘটে যায়নি, সেটাই আশ্চর্য। শহরের সর্বত্র তখন এমন আধুনিকতার ছাপ পড়েনি। মেয়েরা বেশির ভাগই তখন বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে অন্তরীণ। তারা লেখা-পড়া শিখছে বটে, স্কুলে কলেজেও যাচ্ছে–কিন্তু সেটা যতটা সম্ভব পুরুষের ছোঁয়া বাঁচিয়ে দৃষ্টি বাঁচিয়ে। আর তাদের সংখ্যাও নামমাত্র। কারণ পনেরো না পেরুতে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় তখন। বাইরের দিকে একটু তাকাবার অবকাশ যখন মেলে তখন তারা পাকাঁপোক্ত মায়ের আসনে বসে।
এমন দিনেই তরুণ মনে মেয়েদের এক বিশেষ অস্তিত্বের জোরালো ঘোষণার রোমাঞ্চ জাগিয়েছিল যশোমতী পাঠক। সেই ঘোষণা প্রাণ সম্পদ হয়ে দেখা দেবে কি প্রগতির বিকার হয়ে, রক্ষণশীল পরিণত বয়সের মহোদয় বা মহিলারা নিঃসংশয় নয় আদৌ। তবু কেউ উৎসাহ দিয়েছে, কেউ বা খুব সন্তর্পণে একটু উপদেশ দিয়েছে কিন্তু বাধা কেউ দিতে পারেনি। মেয়েদের ক্লাব হয়েছিল, মেয়েদের গান-বাজনা শেখার কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। মেয়েদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে বছরে দু-তিনবার অন্তত গোটা শহর মেতে উঠেছিল।
এই সমস্ত পরিকল্পনা আর উদ্দীপনার মূলে যশোমতী পাঠক। ইচ্ছে থাকলেও বাধা দেওয়া সম্ভব হয়নি এই কারণেই।
পনেরো বছরে স্কুলের পড়া শেষ করেছে যখন, তখন সকলে তাকে লক্ষ্য করেছে। উনিশ বছরে কলেজের প্রড়া শেষ করেছে যখন, তখন বহু তরুণের বুকের তলায় আগুন জ্বলেছে। কুড়ি বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছে যখন, তখন সে বলতে গেলে শহরের সমস্ত প্রগতি-পন্থী রমণী কুলের মুরুবি।
এই সবই সম্ভব যে জিনিসটি অঢেল পরিমাণে থাকলে সেই বস্তুটি টাকা। যশোমতীর বাবা চন্দ্রশেখর পাঠকের সেই পরিমাণ টাকা ছিল, যে পরিমাণ টাকা থাকলে স্বর্গের দরজা আর নরকের দরজা দুই-ই অক্লেশে খোলা যেতে পারে। দ্বিতীয় দরজার প্রশ্ন এখানে নেই কারণ, নিজের উপার্জনের টাকা চেনার মতো চোখ লোকের সচরাচর থাকেই। বিশেষ করে সে যদি ব্যবসায়ী হয়। চন্দ্রশেখরও টাকা চিনত, টাকার সম্মান করতে জানত, টাকার জাল ফেলে টাকা তুলতে পারত।
সূতো আর কাপড়ের কলের ব্যবসা এখানে সুদূরকালের। কিন্তু সেই যুগে ম্যাঞ্চেস্টার-ফেরৎ চন্দ্রশেখরই বস্ত্রশিল্পের অগ্রগণ্য বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি, অনুরাগীদের মুখে এমন কথাও শোনা গেছে। ব্যবসার স্বর্ণ শিখরে আরোহণের তাগিদে একবার নয়, একাধিকবার সে সাগর পাড়ি দিয়েছে।
এই মানুষের সুরূপা কন্যা বিশ বছর বয়েস পর্যন্ত অবিবাহিতা থাকলে লোকের চোখে কাঁটা ফোটে না। প্রায় তুলনীয় অভিজাত ঘরে এই ব্যতিক্রম বরং অনুকরণীয় বলে গণ্য হয়। বাপ বা অভিভাবকের তাড়ায় বিয়ে যাদের হয়ে গেছে, একটু বেশি বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত থাকার চটক দেখে অনেকে তাদের মনে মনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছে। কিন্তু প্রায় সমতুল্য ঘর সেদিন খুব বেশি ছিল কিনা সন্দেহ। চন্দ্রশেখরের কটন মিল যখন জাঁকিয়ে উঠেছে–তার সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বী তখন একজনও ছিল কিনা সন্দেহ।
গর্বিত, রাশভারী মানুষ চন্দ্রশেখর। সমালোচনা বরদাস্ত করতে পারে না, কোনরকম প্রতিবাদও সহ্য করতে পারে না। নিজের শক্তিতে দাঁড়িয়েছে–নিজের শক্তিতে চলে ফেরে ওঠে বসে। নিজের মগজের ওপর অফুরন্ত আস্থা তার। ফলে, অনেকে তাকে দাম্ভিক স্বেচ্ছাচারী ভাবে, ভয় তোকরেই। কিন্তু বিপুল বিত্তের অধিকারী এই মানুষটি ভিতরে ভিতরে লোক খারাপ ছিল না। প্রবল ব্যক্তিত্বের আড়ালে নিজেকে ঢেকে রেখে লোকের উপকার ছাড়া অপকার কখনো করেনি। কোনো কিছু দৃষ্টি এড়াতো না, কিন্তু ঘরের মেয়েটি যে তার আচার আচরণে সর্বতোভাবে তারই উত্তরাধিকারিণী হয়ে উঠেছিল, সে-সম্বন্ধেই খুব সচেতন ছিল না ভদ্রলোক।
সচেতন হয়েছিল কিছু দেরিতে।
সকলে সমীহ করত তাকে। মনে মনে স্ত্রী কমলাদেবীও একটু ভয়ই করত। ভয় করত বলেই সাড়ম্বরে সেটা অস্বীকারও করত সর্বদাই। কিন্তু জীবন-সংগ্রামের শুরু থেকে চেনা বলে ভদ্রলোকের খিটির-মিটির বাধত এই একজনের সঙ্গেই।
চন্দ্রশেখর সেটা এড়াতে চেষ্টা করত, কিন্তু পেরে উঠত না সব সময়। এত অর্থ আর এতবড় ব্যবসার একটা আনুষঙ্গিক উৎপাতও শরীরে দেখা দিয়েছিল। সেটা ব্লাডপ্রেসার। চুপ করে থাকবে ভাবলেও সর্বদা হয়ে ওঠে না। ফলে চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় করে তোলে, যখন মেজাজ চড়ে। বাড়ির শান্তি বজায় রাখার জন্য একটা স্বাধীনতা বরাবর দিয়ে এসেছে। টাকার স্বাধীনতা। ব্যাঙ্কে স্ত্রীর নামে, ছেলের নামে, আর মেয়ের নামে অঢেল টাকা জমা করে রেখেছে। টাকা অন্যায়ভাবে তছনছ করা হচ্ছে কিনা সেটা শুধু খোঁজ-খবর করত ছেলে গণেশ পাঠকের বেলায়। ছেলেরা যত সহজে টাকা নষ্ট করতে পারে, মেয়েরা তার সিকিও পারে না বলে তার ধারণা। টাকা নষ্ট হলেও আক্ষেপ নেই খুব, কিন্তু ছেলে বিপদে পা বাড়ালে সেটা সহ্য হবে না। মেয়ে অথবা মেয়ের মায়ের খরচ নিয়ে ভদ্রলোক একটুও মাথা ঘামাত না। তাদের খরচ বলতে তো শুধু শাড়ী-গয়না-পার্টি আর পার্টির চাঁদা। কত আর খরচ করবে?