দু’চোখ বড় বড় করে প্রায় আমার মুখোমুখি ঘুরে বসল শঙ্কর সারাভাই।
–আপনার নামটা কি মিস্টার….?
নাম যশোমতীই বলে দিল।
আরো একটু সহানুভূতি নিয়েই যেন শঙ্কর সারাভাই আমাকে নিরীক্ষণ করল। তারপর বলল, মহিলার অনুরোধ আমি সচরাচর রক্ষা করে থাকি। আমাদের দেশে এসে আপনি এরকম সমস্যায় পড়েছেন সাহায্য তো করাই উচিত। কিন্তু–আমি জমিজমার প্লট বুঝি, গল্পের প্লট—সে আবার কি?
জবাব দিলাম, খুব তফাৎ নেই, গল্পেরও তো কিছু জমি-জমা দরকার, নয়তো দাঁড়াবে কার ওপর?
হাসিমুখে যশোমতী পাঠক সেতারে রিন-রিন শব্দ করতে লাগল। ছদ্ম বিরক্ত মুখ করে শঙ্কর সারাভাই বাধা দিল, আঃ, ব্যাপারটা বুঝতে দাও ভালো করে। আবার আমার দিকে ফিরল, তা আপনার কি রকম প্লট চাই, নরম মাটির না শক্ত মাটির? আই মিন, ঠিক কোন্ রকম প্লটে কি ফসল ফলাতে চান না বুঝলে ব্যবস্থা করি কি করে?
জবাব দেওয়ার ফুরসৎ মিলল না। বেগতিক দেখে যশোমতী ধমকে উঠল তাকে, তোমাকে আর ব্যবস্থা করতে হবে না, থামো।
–দেখলেন? একেই বলে অস্থিরমতি রমণী-চিত্ত। শঙ্কর সারাভাইয়ের আর এক দফা সেই জোরালো হাসি।
গল্পে গল্পে রাত মন্দ হল না। আর রাত হওয়ার দরুন এক সময় এই আসর ভাঙল বলে ঘড়ি বস্তুটার ওপরেই রাগ হতে লাগল আমার। যাবার আগে আন্তরিক সৌজন্যে শঙ্কর সারাভাই তার বাড়িতে চায়ের নেমন্তন্ন করল আমাকে। যার খাতিরে এই আমন্ত্রণ তাকে কিছু বলল না দেখে ঈষৎ বিব্রত বোধ করেছি।
.
কিন্তু মহিলা নেমন্তন্নের ধার ধারে বলে মনে হল না। যথা দিনের যথাসময়ে যশোমতীই আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল। শঙ্কর সারাভাই বাংলা বোঝে, বলতে পারে না। আমিও হিন্দী বুঝতে পারি, প্রকাশে বিভ্রাট। কিন্তু তা সত্ত্বেও হাসি-খুশির মধ্যেই সময়। কেটেছে। মনে হয়েছে, শঙ্কর সারাভাই তেমনি এক পুরুষ, অনায়াসে যে সমস্ত বাধা ডিঙিয়ে যেতে পারে। ভাষার অন্তরায় সেখানে তুচ্ছ।
লেখার প্রসঙ্গে মহিলাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আমার হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বলেছে, লিখুন তত মশাই, দুনিয়ার সব থেকে সেরা অকরুণ কোনো মহিলার গল্প লিখুন দেখি। সে-রকম গল্প দুনিয়ায় কেউ লিখেছে কিনা জানি না। যদি পারেন একটা মস্ত কাজ হবে, ব্যই বি কেয়ারফুল, পাথরের থেকেও শক্ত নারী-চরিত্র চাই- যে নিজের প্রতি অকরুণ, অন্যের প্রতি অকরুণ, অথচ সক্কলে তাকে করুণাময়ী ভাবছে।
রমণীর ভুরুর শাসন সত্ত্বেও হা-হা শব্দে সেই হাসিই হেসে উঠেছে শঙ্কর সারাভাই।
নিচের পাথরের ওপর উঁচু পাহাড়ী জলপ্রপাত ভেঙে পড়তে দেখেছি আমি। সেই আঘাতে পড়ন্ত জলের বেগকে ভীমগর্জনে শতধা হয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে একলক্ষ মুক্তার হাসির মত ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি। কিন্তু সেদিন এই সরব হাসি দেখে মনে হয়েছিল, জলপ্রপাতের সেই দৃশ্যের সবটুকুই কি হাসি? সবটুকুই সুমহান বিশাল বটে, নিছক হাসি কি সবটুকু?
আরো দু’চার দিন এসে গল্প-গুজব করে গেছি ভদ্রলোকের সঙ্গে বসে। কি পেয়েছি বা কতটুকু পেয়েছি, সেটা সে-সময় খেয়াল করিনি। এদিকে অবকাশ সময়ে যশোমতীর সঙ্গে বসে গল্প তো করেইছি। আমাকে রসদ জোগানোর আগ্রহে সে একটা কথাও বলেনি কখনো। সহজ অন্তরঙ্গতায় সে তার বাবা, মা আর বড় দাদার গল্প করেছে, ব্যবসার গল্প করেছে, এমন কি কৌতূহল প্রকাশ করলে শঙ্কর সারাভাইয়ের বেপরোয়া স্বভাবের গল্পও করেছে। সেই গল্প করার মধ্যে কোন উচ্ছ্বাস ছিল না, কোনরকম আবেগের আতিশয্যও না। কিন্তু তবু আমি যেন কিছু একটা উদ্দেশ্যের মোহনার দিকে এগিয়ে যেতে পেরেছি। পেরেছি যে, সেটা পরের অনুভূতি। তখন উদ্দেশ্য ভুলে কান পেতে শুনেছি শুধু। ঐশ্বর্য-বিলাসে মগ্ন হয়েও সহজতার এই রূপ কোনদিন ভোলবার নয়।
সম্ভাব্য কাহিনীর উচ্ছ্বাস এবং রোমাঞ্চের দিকটা ভরাট করে তোলার লোকের অভাব নেই। ত্রিপুরারি আছে। আর প্রবাসী বাঙালী বন্ধুরা তো আছেই। তাদের কাছে তিল কিছু নেই, সব তাল।
মনে মনে নিজেকে ধন্যবাদ দিয়েছি। দিয়েছি এই জন্যে যে বোকার মতো অসুখের সেই মিথ্যে আশ্রয় না নিলে, আর ঠিক তেমনি অসহায়ভাবে ধরা না পড়ে গেলে মহিলার মনটিকে ঠিক এমন করে এমন সুরে ধরার সুযোগ পেতাম কিনা জানি না। আর আরো একটা কথা মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, প্রায় জ্ঞাতসারেই যশোমতী পাঠক আমাকে কিছুটা প্রশ্রয় দিয়েছে, অর্থাৎ নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখার তাগিদ ভুলেছে। গোচরে হোক বা অগোচরে থোক, সমস্ত পরিপূর্ণতারই একধরনের বেদনাভার আছে। সেটা হয়তো আপনিই প্রকাশের পথ খোঁজে। প্রশ্রয় হয়তো এই কারণে।
আজকের যশোমতী পাঠকের পরিপূর্ণতার আড়ালে এই বেদনার দান কতটুকু, সেটা শুধু কল্পনাসাপেক্ষ কিনা বলতে পারব না। মোট কথা, যে দুটি নারী-পুরুষের হৃদয়চিত্র আমি আঁকতে চলেছি, তাতে কতখানি রঙ ফলানো হয়েছে, সে-সম্বন্ধে আমার নিজেরই কোনো ধারণা নেই। যদি হয়েও থাকে রঙ ফলানো, সে রঙ আমার নিজস্ব নয়। সেই রঙের জন্য আমি ঋণী ত্রিপুরারির কাছে আর প্রবাসী বাঙালী বন্ধুদের কাছে তো বটেই, হয়তো শঙ্কর সারাভাই আর যশোমতী পাঠকের কাছেও।
০৪. যশোমতী পাঠক
যশোমতী পাঠক একবার বাড়ি থেকে পালিয়েছিল।
আজকাল ছবিতে গল্পে যে-রকম পালানো দেখা যায়, ঠিক সেই রকম পালানো। আর ছবিতে পালানোর যে সব কারণ দেখা যায়, সেই গোছেরই পালানো। যশোমতী পাঠক সেই পালানোর মহড়া দিয়েছে আজ থেকে কুড়ি বছর আগে। বয়স যখন তার টেনে-টুনে এক কুড়ির বেশি নয়–তখন।