বক্তব্যের ভূমিকাস্বরূপ ঘটা করে বড় নিঃশ্বাস ফেলতে হল একটা, বললাম, বর্তমান বড় কৃপণ, নিজেকে কেবল আগলে রাখে। ফলে কেউ তার সম্পর্কে বাড়িয়ে বলে কেউ কমিয়ে। সঠিক হদিস কেউ দিতে পারে না, লিখি কি করে বলুন?
মহিলা যথার্থ অবাক। আপনি কার কথা বলছেন?
আমি হাসতে লাগলাম। সেই হাসি থেকেই তক্ষুনি বুঝে নিল। আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত মুখে রক্ত-কণা ছোটাছুটি করতে লাগল যেন। তারপর সামলে নিয়ে দু’চোখ কপালে তুলে মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক। এই মতলব আপনার, অ্যাঁ? আপনি কোথায় কি শুনেছেন শুনি?
সরলতার একটা সহজ ফল আছেই। সবিনয়ে জানালাম, শোনার ব্যাপারে প্রথম সহায়তা আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি, শাহীবাগ থেকে ফেরার পথে সেদিন আপনিই বলছিলেন, আপনাকে নিয়ে শহরে টি-টি।
মুখ থেকে লজ্জার আভা মিলাতে সময় লাগল। জিজ্ঞাসা করল, আর সেই শুনেই আপনি কি নিয়ে ঢি-ঢি খোঁজ-খবর করতে লেগে গেলেন?
মাথা নাড়লাম। তাই।
ঠোঁটের ফাঁকে হাসি চেপে চুপচাপ চেয়ে রইল একটু।–আমি এই শহরের একজন মহা গণ্যমান্য ব্যক্তি বেস কিছু লিখে ধরা পড়েছেন কি মানহানির কেস করব, খুব সাবধান।
আমি বিনয়াবনত আরো নির্দ্বিধায় আর এক ধাপ এগোলাম। –সেই জন্যেই তো আপনার সাহায্যপ্রার্থী।
লজ্জাগোপনের সুচারু প্রয়াস আবারও।– আপনি ভয়ানক লোক, আমি খাল কেটে কুমীর এনেছি।
কি একটা অছিলায় তখনকার মতো উঠে গেছে। খানিক বাদে গানের বায়না পেশ করতে সহজ আন্তরিকতায় সম্মতি-জ্ঞাপন করেছে। গান আগেও দু-তিন সন্ধ্যায় শুনেছি। কিন্তু এই দিনে সর্বরকমে ভাগ্য প্রসন্ন মনে হল। কারণ, মুখ বুজে বসে এই দিন গান আমাকে একা শুনতে হয়নি। দোসর পেয়েছিলাম। সব থেকে সুবাঞ্ছিত দোসর বোধ হয়….
বাইরে থেকে, অর্থাৎ ত্রিপুরারির মুখে এবং বাঙালী ভদ্রলোকদের রসালো জটলা থেকে যে রিপোর্ট পেয়েছিলাম, তাতে মনে মনে প্রতিদিনই এখানে আমি একজনকে আশা করেছি।
কিন্তু আমার আসার সঙ্গে তার আসাটা এ-পর্যন্ত বড় বেখাপ্পা রকমের অমিল হচ্ছিল।
সে শঙ্কর সারাভাই।
এই রাত্রিতেই তার সাক্ষাৎ মিলল।
যশোমতী পাঠক দু’চোখ বুজে গানে তন্ময় তখন। মেঝেতে পুরু গালচে, কারো আসা-যাওয়া টের পাবার কথা নয়, পেলও না। ভদ্রলোক এলো। আমার তন্ময়তার ছেদ পড়ল, নিভৃতের একটা অনুভূতি আনন্দে চঞ্চল হল। শঙ্কর সারাভাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে গায়িকাকে দেখল একটু। তারপর দু’হাত জোড় করে আমার উদ্দেশে নমস্কার জানালো। তারপর তেমনি নিঃশব্দে পাশের আসনে বসল। সপ্রতিভ মুখের অল্প অল্প হাসিটুকু আজ আরো অনেক বেশি ভালো লাগল আমার।
গানের মাঝেই একটু বাদে চোখ মেলে তাকালো যশোমতী পাঠক। আমার পাশে দ্বিতীয় আগন্তুক দেখার ফলে গানের তাল কাটল না বটে, কিন্তু মুখে পলকের লালিমার ছোপ স্পষ্টতর হল বোধ করি। আমার দিকে তাকালো একবার। দু’চোখ বুজেই গাইতে লাগল আবার। শঙ্কর সারাভাই গান শুনছে কি তন্ময় হয়ে কিছু চিন্তা করছে বোঝা ভার। তার দু’চোখ অদূরের দেয়ালের ছবিটার দিকে। আমার ধারণা, যে সময়ে গান শেষ হতে পারত, তার থেকে কিছু’দেরিই হল।
তবু শেষ খানিক বাদে হলই। এরপরেও চোখ বুজে থাকা সম্ভব নয়। যশোমতী তাকালো। হাসল। নিজেই আগে কথা বলে প্রশংসা এবং আবার গানের অনুরোধ একসঙ্গে বাতিল করল হয়তো। আমাকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে শঙ্কর সারাভাইয়ের উদ্দেশে প্রশ্ন করল, আলাপ আছে?
আমার দিকে চেয়ে শঙ্কর সারাভাই আর একদফা পরিচয়সূচক মাথা ঝাঁকালো। কিন্তু যশোমতী আমার নাম বলেনি বা পরিচয় দেয়নি। হাসিমুখে ভদ্রলোক সম্মুখবর্তিনীর দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করল তারপর। নিজেদের ভাষায় বলল, আলাপ হয়েছিল বোধহয়, তাছাড়া মাননীয় অতিথিকে নিয়ে তুমি খুব ব্যস্ত সেটা আগেই শুনেছি।
কেন জানি না, তাড়াতাড়ি নিজেকে নিরপরাধ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা আমার। বললাম, ওনার ব্যস্ততার জন্য আমি নিজেই খুব লজ্জিত।
ঝুঁকে চলা আর মাথা ঝাঁকিয়ে কথা বলা ভদ্রলোকের স্বভাব বোধহয়। সানন্দে মাথা ঝাঁকালো। আপনার লজ্জার কিছুমাত্র কারণ নেই, ওঁর কাছে আপনারা প্রিভিলেজড, ক্লাস, লেখকদের সাত খুনও উনি মাপ করে দিতে পারেন–এ তো মাত্র একটা খুন।
ঘুরিয়ে বললে দাঁড়ায়, মহিলাকে ব্যস্ত রাখার দরুন সেই একটা মাত্র খুন যাকে করা হয়েছে সেই ব্যক্তিটি উনি। এত বড় ঘরটাকে সচকিত করে হা-হা শব্দে হেসে উঠল। জোরালো পুরুষ, জোরালো হাসি। এ-রকম এক হাসিতে স্বল্প পরিচয়ের সমস্ত সঙ্কোচ ধুয়ে মুছে যাবার মতা। হাসি মিলাতে সাগ্রহে মহিলাকে লক্ষ্য করছি আমি। সেই মুখে ছদ্ম ভ্রুকুটি।অত হাসার কি হল?
মুখখানা কঁচুমাচু করে ভদ্রলোক আমার দিকে ফিরল।-হাসি পেলে মেপে হাসা যায়, আপনি বলুন?
আমি মাথা নাড়লাম। যায় না।
যশোমতী পাঠক নিজেই হাসতে লাগল এবার। বলল, লেখককে আমি তোমার কাছে পাঠাব ভাবছিলাম, ভদ্রলোক বেশ মুশকিলে পড়েছেন। গল্পের প্লট খুজছেন–পাচ্ছেন না। হতাশ হয়ে দেশে ফেরার মতলব করছেন, তুমি দাও না কিছু ব্যবস্থা করে।
চোখ দিয়ে, কান দিয়ে, মন দিয়ে রসদ আমি নিজেই সংগ্রহ করেছি। শঙ্কর সারাভাইয়ের পরিচয় যশোমতী আমাকে দেয়নি। এটা যে ভুল তা আমার মনে হয়নি। কিন্তু ভদ্রলোককে যে আমি চিনি সেটা সে বুঝেছে। তবু কোনো রকম বিড়ম্বনা বা সঙ্কোচ দেখিনি। অতিথির হয়ে এই সুপারিশও খুব সাদাসিধেভাবেই করল। এর আড়ালে যে কৌতুক প্রচ্ছন্ন সে শুধু উপলব্ধির বস্তু। নির্লিপ্ত চোখে মুখে ওই কৌতুক চিকচিক করছে কিনা দেখার জন্য আমার অবাধ্য দৃষ্টি ওই মুখখানাকেই চড়াও করেছিল।