লজ্জা পেলাম, যখন আধুনিক লেখকদের সারি থেকে যশোমতী হাসিমুখে আমার লেখা প্রতিটি বই টেনে টেনে দেখাতে লাগল কিন্তু প্রশংসার বদলে অনুযোগের সুরটাই স্পষ্ট করে তুলতে চেষ্টা করল। বলল, আপনার কোনো কোনো লেখা, বিশেষ করে ট্র্যাজেডি গুলো এত বেশি আপত্তিকর যে পড়তে পড়তে মনে হত আপনাকে সামনে পেলে তর্ক তো করবই, ঝগড়াও হয়ে যেতে পারে। অথচ এখন দেখুন কিছুই মনে পড়ছে না।
লেখক মাত্রেই প্রীত হবার কথা, আমিও ব্যতিক্রম নই। তবু বললাম, আমার লেখার ওইটেই বোধহয় বড় গুণ, পড়ার পর আর মনে রাখার বালাই থাকে না।
যশোমতী হেসে ফেলেও একটু জোর দিয়েই বলল, না, অতটা নিন্দে অবশ্য করছি না, কিন্তু বেশিরভাগই ট্র্যাজেডি লেখার দিকে আপনার অত ঝোঁক কেন? আর ট্রাজেডি নয় যেগুলো, তারও তলায় তলায় কিছু-না-কিছু ট্র্যাজিক এলিমেন্ট থাকবেই।
হেসে সমালোচনা যথার্থ মেনে নিয়েই জবাব দিলাম, আচ্ছা, আপনার খাতিরে একটা বই অন্তত পরের সংস্করণে অন্যরকম করে দিতে রাজি আছি–যে-কোনো একটা বইয়ের নাম করুন, বদলে স্ট্রেইট কমেডি করে দেব।
বিপদাপন্ন মুখশ্রী যশোমতীর। প্রায় হার মেনে মন্তব্য করল, আপনি আচ্ছা জব্দ করতে পারেন।
খুশি মুখে প্রসঙ্গ বদল করলাম, জিজ্ঞাসা করলাম, এত বই আপনি পড়ার সময় পান কখন?
–কেন, বই পড়েই তো সময় কাটাই কোন রকমে। আর কি কাজ?
–এত বড় একটা ব্যবসা চালাচ্ছেন–ত্রিপুরারিতে বলে আপনার মতো এতবড় ব্যবসা এখানে আর কারো নেই।
হেসে জবাব দিল, নিজের জিনিস সবাই বড় দেখে, ঘোষবাবুর তো কথাই নেই। তা ছাড়া ব্যবসা খুব বড় হয়ে গেলে আপনিই চলে। চালানোর একটা শো রাখতে হয় বটে, কিন্তু আসলে তেমন কিছু করতে হয় না।
ভালো লাগছিল। প্রতিটি কথা ভালো লাগছিল। হাসি ভালো লাগছিল। হাসির আভাসটুকুও ভালো লাগছিল।
শহর দেখার জন্য আর লেখার রসদ সংগ্রহের জন্য পরদিন থেকে ঝকঝকে একটা গাড়ি আমার হেপাজতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সাত দিন ছেড়ে বাকি পনেরো দিনই এখানে আমি অতিথি হয়ে ছিলাম। যশোমতী অনুরোধ করেছে। আমার যেটুকু সঙ্কোচ তা ত্রিপুরারির জন্য। ওর বউও ভাবতে পারে বড়লোকের আতিথ্য পেয়ে ওদের ভুলেছি। কিন্তু আপত্তি করা দূরে থাকুক, বরং সাগ্রহে সায় দিয়েছে। আড়ালে উৎসাহ দিয়েছে। ওখানেই থেকে যাও বন্ধু, অনেক মনের মতো মালমশলা পেয়ে যাবে–তাছাড়া আমার সঙ্গে দেখা তো রোজই হচ্ছে, বললে দু’বেলাই আসতে রাজি আছি। সাহিত্যিকের বন্ধু হলেও যে এত খাতির মেলে এ বাপু এই প্রথম জানলাম। গলা খাটো করে আর সেই সঙ্গে কনুইয়ের একটা গুতো দিয়ে আবার বলল, একটুও ঘাবড়াবার দরকার নেই, যা জানার ইচ্ছে শপাং করে মুখের ওপর জিজ্ঞাসা করে বসবে। তোমাকে দেখার আগে থেকেই তোমাকে পছন্দ যে হে, নইলে অত করে বলত না।
সকালের দিকে আমার হোস্টেসের অবকাশ কম। চায়ের টেবিলে দেখা হয়। তখনই যেটুকু কথাবার্তা হয়। তারপর সে কাজ নিয়ে বসে, আমি হয় গাড়ি নিয়ে বেরোই নয়তো লাইব্রেরিতে থাকি। এরপর দেখা হয় দুপুরে খাবার সময়। ফ্যাক্টরী থেকে এই সময় ঠিক ঘড়ি ধরে ফিরে আসে। আমার ধারণা ছিল এই রীতিতেই বুঝি অভ্যস্ত কত্রীটি। কিন্তু পরে একজন পরিচারকের মুখে শুনলাম তা নয়, বাড়িতে অতিথি আছে বলেই ফিরে আসে, নইলে তার দুপুরের খাবার ফ্যাক্টরীতেই নিয়ে যেতে হয়।
শুনে খুশি হয়েছি আবার সঙ্কোচও বোধ করছি। একটু এদিক ও-দিক হলেই অতিথি বিগড়ায় ভেবেই ভদ্রমহিলা কষ্ট করে আসে কিনা কে জানে। সেদিন বললাম, আপনি তো ফ্যাক্টরীতেই লাঞ্চ করেন শুনেছি, আমার জন্যেই কষ্ট করে আসতে হচ্ছে আপনাকে–এর কিছু দরকার নেই, যারা ছে তারা আদর যত্ন কম করছে না।
যশোমতী তক্ষুনি বলল, আপনি আমার ঘরের খবর নিতে গেছেন কেন? তরল কৌতুক-ভরা প্রসন্ন মুখ, আমার বার কতক শরত্যাবু পড়া আছে মশাই–সামনে বসে না খাওয়ালে আপনাদের মেজাজ ঠিক থাকে না।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে জবাব দিলাম, শরৎবাবুর যুগ গেছে, মেয়ের। বসে এখন শুধু বিষম খাওয়ায়।
চোখ পাকালো, মিথ্যে কথা, শরৎবাবুর যুগ যে একেবারে যায়নি সেটা আপনারও দুই একখানা বই থেকে প্রমাণ করে দিতে পারি।
গল্প জমে বিকেলে বা সন্ধ্যার পর। আমি সেই প্রতীক্ষায় থাকি। সেদিন গাড়ি নিয়ে বহুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ফেরার পর প্রথম সাক্ষাতে মহিলা জিজ্ঞাসা করল, আজ কি দেখলেন?
–বিশেষ কিছু না। ঘুরলাম শুধু।
ঈষৎ কৌতুকে আবার প্রশ্ন করল, আপনি এখানকার কি নিয়ে লেখার কথা ভাবছেন?
–লিখবই যে এ আপনাকে কে বললে?
একটু অপ্রস্তুত হয়ে জবাব দিল, ঘোষবাবু বলছিলেন লেখার জন্যেই নাকি আপনি থেকে গেলেন এখানে, নইলে সাহিত্য অধিবেশন শেষ হলেই পালাতেন।
স্বীকার করলাম, বললাম, বাসনা সেই রকমই ছিল বটে। কিন্তু কি লিখব এখনো ঠিক করা হয়ে ওঠেনি। কখনো পুরাণ হাতড়ে বেড়াচ্ছি, কখনো ইতিহাস, কখনো বা এখানকার বিগত রাজনীতি। লেখা হয়তো শেষ পর্যন্ত হবেই না, কারণ ওগুলোর একটার ওপরেও নির্ভরযোগ্য দখল নেই।
মুখের দিকে চেয়ে থেকে যশোমতী হাসল মুখ টিপে-কেন বর্তমান পছন্দ হচ্ছে না?
আশায় আশায় বড় লোভনীয় বাসনার দিকেই বেপরোয়া হাত বাড়িয়ে ফেললাম। কনুইয়ে গুতো দিয়ে ত্রিপুরারি শপাং করে বলে বসার পরামর্শই দিয়েছিল। ওর কল্যাণে আর এখানকার প্রবাসী বাঙালী আলাপীদের সঙ্গে একটু অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠার ফলে গল্পে গল্পে যে রসদের সন্ধান পেয়েছি, সেটা সত্যিই আরো কতগুণ লোভনীয় হয়ে উঠেছে এই ক’দিনে তা আর কে জানে?