মহিলার সমস্ত মুখখানাই কমনীয় হাসিতে ভরে উঠছিল এবার। কিন্তু শেষের কথায় লজ্জা পেয়ে বলে উঠল, ছি, ছি, ঘোষবাবু আমাদের আপনার লোক, তাকে আমি বন্ধু মনে করি। কিন্তু আপনার একটুও অন্যায় হয়নি, আপনি উচিত শিক্ষাই দিয়েছেন। আপনার বই টইগুলো আমার পড়া আছে যখন এ-রকম ভুল করা আমার উচিত হয়নি। বলতে বলতে আবারও হেসে উঠল।
যুক্ত করে করে বললাম, আর লজ্জা দেবেন না।
তক্ষুনি তরল জবাব দিল, দেব, যদি না আপনি আমার ভুল সংশোধন করার সুযোগ দেন। দিন সাতেক অন্তত এখন আপনি খুব লক্ষ্মী ছেলের মতো আমার গেস্ট হয়ে থাকুন তো। চিন্তা নেই, বাড়ি গিয়েই আমি টেলিফোনে ঘোষবাবুকে জানিয়ে দিচ্ছি আপনি দিনকতক এখন ফিরছেন না।
অস্বীকার করব না, এই নতুন জায়গা, নতুন জায়গার মানুষেরা, এই সাবরমতী গত কদিন ধরে আমাকে যত না আকৃষ্ট করেছে, স্বল্প আলাপে সূচ্যগ্রবুদ্ধি এই সুদর্শন মহিলা আমাকে তার থেকে অনেক বেশি টেনেছে। অন্তরঙ্গ আমন্ত্রণও লোভনীয় মনে হয়েছে তাই। কোনো অবিবাহিত রমণীর পক্ষে এ-ধরনের দ্বিধাশূন্য আমন্ত্রণ সঙ্গত কিনা, সে সমস্যা মনে কোণেও উঁকিঝুঁকি দেয় নি।
তবু অভ্যাসগত ভব্যতার দিক আছে একটা। বললাম, এতখানি অপরাধের পরেও আমার ভাগ্য প্রসন্নই ধরে নিলাম।….কিন্তু আজ থাক, পরে আপনার আতিথ্য সানন্দে মাথা পেতে নেব।
মহিলা সহজ আন্তরিকতায় মাথা নাড়ল। বলল, উহ, আজই, মানে আজকের থেকেই। আসলে আপনি লজ্জা পাচ্ছেন। রাজি না হলে আমার হাতে অস্ত্র আছে–ঘোষবাবুর কাছে আপনার অসুখের কথা ফাঁস করে দেব। তাঁর এখনো ধারণা আর একটু হলেই অসুখটা আপনার বেশ খারাপের দিকে গড়াতে। কালও বলছিলেন সে কথা।
এরপর সানন্দে এবং শশব্যস্তে বশ্যতা স্বীকার। বললাম, ওর স্ত্রীর হাতে প্রায় ধরা পড়েছি, তার ওপর আপনার এই অস্ত্র ঘাড়ে পড়লে এ-জায়গা ছেড়েই পালাতে হবে আমাকে।
যশোমতী পাঠক খুশি হয়ে হাসতে লাগল। আলাপ আরো সহজতর করার চেষ্টা আমার। বললাম, খুব খুশি-চিত্তে আপনাকে ইচ্ছেমত অতিথি-সৎকারের সুযোগ দিতে রাজি, কিন্তু আমার দিক থেকেও সামান্য একটুখানি শর্ত থাকবে।
রমণীমুখের চকিত কারুকার্য নয়নাভিরাম। সভয়ে বলে উঠল, কি শর্ত, আপনার গল্পের মেটিরিয়াল জোগাতে হবে না তো?–এমনিতেই তো আমাকে নিয়ে শহরে টি-টি।
ঠিক এই মুহূর্তেই, অর্থাৎ, এই উক্তির পরেই কি নিয়ে লিখব সে-চিন্তাটা আমার অবচেতন মন থেকে ঘুচে গেছল কিনা সঠিক বলতে পারব না। হয়তো তাই। কিন্তু মহিলার ওই কথা আর ওই হাসির সঙ্গে সঙ্গে নিজের মনের ভিতরটা তলিয়ে দেখার অবকাশ তখন ছিল না। হেসে জবাব দিলাম, এইটুকুর মধ্যে অত বড় লাভের দিকে হাত বাড়াতে সঙ্কোচ–আমি গান শোনার বায়না পেশ করতে যাচ্ছিলাম।
প্রসন্নবয়ানে মহিল। তৎক্ষণাৎ রাজি। বলল, এ আবার একটা শর্ত নাকি! সাহিত্যিককে গান শোনাব এ তো ভাগ্যের কথা, ভালো লাগলে যত খুশি শুনবেন।
মস্ত ফটকের ভিতর দিয়ে গাড়ি ঢুকে গেল। চারিদিকে পাঁচিল ঘেরা। সামনে লন্, পিছনে বাগান। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলা যেতে পারে। দূর থেকে আগেও একবার দেখেছিলাম। কিন্তু দূর থেকে ঠাওর হয় না।
না, এ-হেন আবাসে অতিথিকে ডেকে আনার ব্যাপারে রমণীরও সঙ্কোচের কারণ না থাকাই স্বাভাবিক। মহিলা সংসারী নয় বটে, কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে এখানে অনেকগুলো সংসারের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। প্রাসাদ-সংলগ্ন হাল-ফ্যাশানের গেস্ট হাউস। ম্যানেজার, সেক্রেটারী, কেয়ারটেকার আর দাস-দাসী–সব মিলিয়ে এখানকার বাসিন্দার সংখ্যা কত, আজও সঠিক বলতে পারব না। বাড়ির পিছনদিকে একসারি পাকা সারভ্যান্টস্ লজ। সামনের দিকে গেস্ট হাউস, সার ওধারের একপাশ জুড়ে ম্যানেজার, সেক্রেটারী আর কেয়ারটেকারের আলাদা আলাদা কোয়ার্টার্স।
এরকম এক জায়গায় এসে পড়ে আমার প্রতি মুহূর্তে বিব্রত বোধ করার কথা। ত্রিপুরারির বউয়ের নীরব তদারকেই কত সময় বিব্রত বোধ করেছি। এখানে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালে দু’জন করে লোক দৌড়ে আসে–কিছু চাই কি না। অথচ চাওয়ার অপেক্ষায় যে এখানে থাকতে হয় না, সে বোধহয় ওরাও জানে। যে ব্যবস্থা তার ওপরেও কিছু চাইতে হলে গবেষণা করে বার করতে হবে। প্রথম আধঘণ্টা একঘণ্টা এই পরিবেশে নিজেকে ভয়ানক বেখাপ্পা লাগছিল বটে। কিন্তু আশ্চর্য, তারপরে সেভাবটা কেটে যেতে সময় লাগেনি।
ঐশ্বর্যপুরীই বটে, তবু অতটা সহজ নিঃসঙ্কোচ হতে পেরেছিলাম কি করে ভাবলে অবাক লাগে। পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে তো সাত দিন থাকতে হবে ভেবে উতলা হয়ে পড়েছিলাম। মনে হয়, ঐশ্বর্য এখানে সীমিত নয় বলেই সঙ্কোচ আপনই সরে গেছে। কৃত্রিম হ্রদকে বহু রকমে সাজিয়ে গুছিয়ে চোখ ঠিকরে দেওয়া যায়। কিন্তু সমুদ্রের আর এক রূপ। সমস্ত উচ্ছলতা নিয়েই সমাহিত রূপ তার। এও যেন অনেকটা তাই। প্রথমে তাক লাগে বটে, পরে মনে হয় ঐশ্বর্য এখানে ধ্যানে বসেছে। কোন রকম হঠাৎ-চমক নেই, দৃষ্টিকে পীড়া দিয়ে ঈর্ষা জাগানোর ঠমক নেই। যা আছে, তা থাকলেই যেন মানায়।
নিজস্ব ঐশ্বর্য বলতে যশোমতী সাগ্রহে প্রথমে আমাকে যে জিনিসটি দেখাল, সেটা তার লাইব্রেরি। লাইব্রেরি অনেক দেখেছি, কিন্তু এত বড় অথচ এমন সুচারুশৃঙ্খলাবদ্ধ নিজস্ব পাঠাগার কমই চোখে পড়েছে। শুনলাম এটি তদারক করার জন্য একজন এক্সপার্ট লাইব্রেরিয়ানও আছে। বাংলা ছেড়ে বিশাল ইংরেজি সাহিত্যের ধারা নিয়েও কেউ যদি গবেষণা করতে চান, মনে হয় এখানে বসেই তিনি মোটামুটি রসদ পেয়ে যেতে পারেন।