যশোমতী বলল, ভালো করেছেন, আমি তো ভালই দেখছি এখন, কাল আপনি ঘাবড়ে দিয়েছিলেন প্রায়। এই উক্তি ত্রিপুরারির উদ্দেশে। তারপর আমার দিকে ফিরে আবার বলল, ডাক্তারবাবু অবশ্য দেখে গিয়ে জানিয়েছেন তেমন কিছু হয়নি, তবু কালই আসা উচিত ছিল আমার, গেস্টরা ছিলেন বলে হয়ে উঠল না। আজ চারটের গাড়িতে শেষ গেস্ট বিদায় নেবার পর কর্তব্য করতে বেরিয়েছিলাম। আপনি এত ভালো আছেন দেখে অবশ্যই আরো বেশি খুশি হয়েছি।
হাসিমুখের এই আন্তরিক কথাগুলো কানে কেন যেন খুব সরল ঠেকল না। কেবলই মনে হল, মহিলা বুদ্ধিমতী, এই সাদাসিধে উক্তির পিছনে কিছু একটা কৌতুক প্রচ্ছন্ন। অবশ্য, শারীরিক অসুস্থতার মিথ্যাচার প্রসঙ্গে নিজে আমি সচেতন বলেও এ-রকম মনে হতে পারে।
দু’চার কথার ফাঁকে আরো খানিকক্ষণ শাহীবাগ দেখা হল! যশোমতী জিজ্ঞাসা করল, এর ওপর লিখবেন নাকি?
–ভাবিনি কিছু….
ঠোঁটের ফাঁকে সকৌতুক হাসি দেখা গেল আবার। বলল, এখানে এসে সব লেখকই খুব ইন্সপায়ার্ড হয়ে শাহবাগ দেখেন, দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটান এখানে, মনে হয় ফিরে গিয়েই বড় গোছের কিছু একটা লিখে ফেলবেন। কিন্তু শেষে ক্ষুধিত পাষাণের ভয়েই আর কিছু লেখেন না বোধহয়।
অযোগ্যতার খোঁচা কিনা বোঝা গেল না। মন্তব্য করলাম, ক্ষুধিত পাষাণের পর লেখা তত খুব সহজ নয়।
স্বীকার করে নিয়ে তক্ষুনি মাথা নাড়ল।–তা বটে।
ফেরার সময় মহিলা তার গাড়িতে ওঠার জন্য আপ্যায়ন করল। কোনরকম আপত্তি করার অবকাশ না দিয়ে ত্রিপুরারিকে লল, আপনি আপনার গাড়ি নিয়ে চলে যান, আপাতত একে আমার বাড়িতে ধরে নিয়ে যাচ্ছি।
নিজে বাড়ি বয়ে দেখতে এসেছিল, তারপরে সাবরমতীর ধারে খোঁজাখুজি করে এই পর্যন্ত এসেছে–আমার আপত্তির যথার্থ কোনো কারণ নেই আর। তাছাড়া এই রমণীসঙ্গ অবাঞ্ছিত নয়। কিন্তু ত্রিপুরারিও আপত্তি করল না দেখে ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি বোধ করলাম একটু। অসুখের ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ক ক্ষতি নেই, কিন্তু তার গুরুত্বও না এরপর ফিকে হয়ে যায়।
তাই মৃদু দ্বিধা প্রকাশ করলাম, আজ থাক না, আর একটু তাজা হয়ে পরে না হয় একদিন যাব’খন। আছি তো এখন দিন কতক।
মুখের দিকে দুই এক পলক চেয়ে থেকে যশোমতী জিজ্ঞাসা করল, কেন, শরীরটা এখনো তেমন ভালো লাগছে না?
প্রশ্নটা নয়, চোখের চাপা হাসিটা আমাকে বিব্রত করেছে। তাড়াতাড়ি জবাব দিয়ে বাঁচার চেষ্টা, বললাম, না, শরীর এখন ভালই আছে।
–তবে আর কি, আসুন। আর কথা না বাড়িয়ে নিজের হাতে গাড়ির দরজা খুলে দিল।
অতঃপর বিনা বাধায় আমাকে উঠে বসতে দেখে ত্রিপুরারিরই দায় বাচল যেন। গাড়ি ছাড়তে ও-পাশের দরজার কোণে ঠেস দিয়ে মহিলা হাসিমুখে বলল, আপিন এখানে আসছেন শোনার পর থেকেই আপনার সঙ্গে আলাপ করার বিশেষ ইচ্ছে ছিল। এ ক’দিনের মধ্যে হয়েই উঠল না….কিন্তু সেজন্যে আমার থেকেও ঘোষবাবু বেশি দায়ী–তিনি আমাকে বললেন, বন্ধু আমার ঘরের লোক, তার জন্য আপনাকে একটুও ব্যস্ত হতে হবে না, আপনি এদিকের অভ্যাগতদের দিকে মন দিন।
এ আবার কোন ধরনের উক্তি! মহিলার ঠোঁটের ফাঁকে সহজ মিষ্টি হাসিটুকু লেগে আছে। কিন্তু আমার ঘেমে ওঠার দাখিল। একটু আগে ত্রিপুরারির সামনে মহিলার আচরণে বা মুখের সামান্য। হাসিতে যে কৌতুক প্রচ্ছন্ন মনে হয়েছিল, এখন সেটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠার আশঙ্কা। জবাব না দিয়ে বোকার মতো আমি তার কথার অর্থ বুঝতে চেষ্টা করলাম যেন।
গাড়িতে বসার শিথিল ভঙ্গিটুকুও চুরি করে দেখার মতই লোভনীয়। কিন্তু এর পরের উক্তি কোনদিকে গড়াবে আপাতত সেই সশঙ্ক প্রতীক্ষা আমার। যশোমতী বলল, গান শুনে সেদিন আপনি প্রশংসা করে গেলেন, কি লজ্জা, এত লোকের মধ্যে আমি ঠিক। খেয়ালই করতে পারলাম না–একদিন তো মাত্র দেখেছিলাম। পরে মনে হয়েছে। তার ওপর আবার ঘোষবাবুর কথায় পড়ে নিজে গিয়ে নেমন্তন্ন করলাম না, আমার ভদ্ৰতাজ্ঞান আর অতিথিপরায়ণতার বহর দেখে আপনি তো একেবারে অসুখই বাঁধিয়ে বসলেন। খুব লজ্জা পেয়েছি।
সুবিনয়িণী যথার্থই লজ্জা কতটুকু পেয়েছে জানি না, কিন্তু গাড়ি থামালে আমি বোধহয় পালিয়ে বাঁচতুম। যে মহিলা কোটি কোটি টাকার ব্যবসা চালাচ্ছে, কটন চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হয়েছে তার বুদ্ধির প্রতি আমার খুব যে অনাস্থা ছিল তা নয়। শুধু এমন এক রমণীর এই সুচারু হৃদয়ের দিকটাই আমি হিসেবের মধ্যে আনিনি। অসুখ শুনে ব্যস্ত হয়ে বাড়িতে ডাক্তার পাঠাবে, আর তারপর ফাঁক পেয়েই স্বয়ং রোগী দেখতে চলে আসবে–এ সম্ভাবনার কথা কে ভেবেছিল।
এই পরিস্থিতিতে যে কাজ সব থেকে সহজ এবং শোভন আমি তাই করলাম। আরো আগেই যা করা উচিত ছিল। হাসতে চেষ্টা করলাম আর তারপরে হাতজোড় করে বললাম, আমি একটি মূখের মতো কাজ করেছি, অপরাধ নেবেন না।
–কি আশ্চর্য, মহিলা হেসে উঠল, অপরাধ তো আমার, আপনার রাগ করাই তো স্বাভাবিক–কি ভেবেছিলেন বলুন তো, এ রকম অভ্যর্থনা জুটবে জানলে কলকাতা ছেড়ে আসতেন না বোধহয়?
এমন সঙ্কটে এই মুখের দিকে চেয়ে এই চোখে চোখ রেখে জবাব দেওয়া যে কত কঠিন, তা মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। মিথ্যার খোলস আগেই ছেড়েছি, এবারে গোটাগুটি সমর্পণ ভিন্ন গতি নেই। বললাম, দেখুন, এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপুরারির মুখে, আর আরো দু চারজন বাঙালীর মুখে আপনার এতবড় পরিচয় পেয়েছি যে মনে মনে বোধহয় হিংসেই হয়েছিল। আর সেজন্যেই হয়তো নিজের ঠুনকো আত্মসম্মানের দিকটা মাথা উঁচিয়ে উঠেছিল। ভেবেছিলাম, ত্রিপুরারি আপনার কর্মচারী বলেই তার অন্তরঙ্গ বন্ধুকে আপনি অবহেলার চোখে দেখলেন।