কিন্তু ক্ষমতা-অন্ধ নবীন বিদ্রোহী জানত না, মৃত্যু হাসছিল তার পিছনে দাঁড়িয়ে। তার হিসেবের সঙ্গে ওপরঅলার হিসেব মেলেনি। ওই সিংহাসন তখন আসলে প্রস্তুত মজফফর-পৌত্র আহমদ শাহকে গ্রহণ করার জন্য। তারই কাছে রক্তের বিনিময়ে নতিস্বীকার করবে প্রতিবেশী রাজপুত আর মালবরাজ–আহমদ শাহ প্রতিষ্ঠিত করবে স্বাধীন গুজরাট–পরের ইতিহাসের এই বিধিলিপি।
কিন্তু বিধিলিপিরও পরমায়ু আছে। ষোল শতকে গুজরাটের ভাগ্যবিধাতা বদলেছে। মোগল-রাজ আকবরের ভ্রূকুটি-শাসনগত হয়েছে এই দেশ। আর জাহাঙ্গীরের সময়ে গুজরাটের এই অঞ্চল দেখেছে রমণীর শাসন। ভাবতে ভালো লাগছে, একটি নয়, এই শহরের ওপর দিয়ে দুটি প্রতিস্পর্ধী রমণীর লীলাধারা উচ্ছল হয়ে উঠেছিল সেদিন। এক রমণী নদী সাবরমতী–দ্বিতীয় রমণী জাহাঙ্গীর মহিষী নূরজাহান ….লিখতে বসে হঠাৎ প্রতিস্পর্ধী শব্দটাই কলমে এলো কেন জানি না। এই দুই রমণীর যৌবনধারায় কতটা মিল ছিল সেদিন আর কতটা অমিল, কল্পনা করতে ইচ্ছে করে।
আঠারো শতকের মাঝামাঝি আবার ক্ষমতা-বদলের পালা। সমগ্র গুজরাট নয়, গুজরাটের এই অঞ্চলটি তখন মারাঠা-শক্তি করতলগত। আর উনিশ শতকের গোড়ায় ইংরেজের।
ইংরেজের!
যে ইংরেজ এখান থেকে নড়বে বলে কেউ ভাবেনি।
কিন্তু ঠিক একশো বছর বাদে এই ইংরেজের পাকা ভিত ভাঙার সাধনায় এখানে আসন পেতে বসল আর একজন। দেশ তার কানে। মন্ত্র দিল, তুমি জাতির জনক, জাতিকে বাঁচাও।
মহাত্মা গান্ধী। সাবরমতীর কূলে একদিন দেখা দিল তার আশ্রম। জাতীয় আন্দোলনের পীঠস্থান।
এই ইতিহাস আর এই অতীতের মধ্যে গত কদিন ধরেই বিচরণ করছিলাম আমি। আজও।
মন্দির-মসজিদের রাজ্য থেকে যখন শাহীবাগে এলাম, তখনো বিকেল ঘন হয়নি। মেঘলা দিন, খাওয়া-দাওয়ার খানিক পরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম।
সম্রাট শাহাজানের শাহীবাস। একান্ত নিরিবিলি জায়গা। আগে আরো নিরিবিলি ছিল শুনলাম। শাহীবাগের নামোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দুটো প্রাসাদ ভেসে উঠবে চোখের সামনে। প্রবাদ অনুযায়ী এক প্রাসাদের সঙ্গে আর এক প্রাসাদের যোগ দুইয়ের মাঝের ভূগর্ভের সুড়ঙ্গপথে। এই নির্জনে এসে দাঁড়ালে দু-কান আপনা থেকে উৎকর্ণ হতে চায় কেন?
পাগলা মেহের আলীর গর্জন কানে আসবে–তফাৎ যাও, সব ঝুট হ্যায়?
ইংরেজ আমলে এখানে চাকরি করতে আসে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন এই শাহীবাগ ছিল তার বাসভবন। বিলেত যাবার পথে সে সময়ে এই প্রাসাদে অবস্থান করেছিল রবীন্দ্রনাথ। ক্ষুধিত পাষাণের পটভূমি সেই শাহীবাগ প্রাসাদ!
আশ্চর্য! সে কোন্ যুগের কথা। সাতাশিটা বছর পার হয়েছে মাঝে। মাত্র আঠারো বছর বয়স তখন রবি ঠাকুরের। তার চিন্তার রাজ্যে সেই তখন জন্মগ্রহণ করেছে পাগল মেহের আলীর কণ্ঠস্বর। আজও সেটা তেমনি অটুট তাজা।
তফাৎ যাও! সব ঝুট হায়!
নিবিষ্ট মনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। মন দিয়ে দেখছিলাম, চোখ দিয়ে দেখছিলাম, কান দিয়ে দেখছিলাম। এই তন্ময়তার ফাঁকে ত্রিপুরারি কখন সরে গিয়ে কোন্ জায়গায় বসে গেছে, খেয়াল করিনি। হঠাৎ সব কটা ধমনীর সবটুকু রক্ত একসঙ্গে নাড়া খেল বুঝি। বিষম চমকে ঘুরে দাঁড়ালাম।
–তফাৎ যাও! সব ঝুট হায়!
না, পাগলা মেহের আলীর বুক-কাঁপানো গলা নয়। রমণীর কণ্ঠস্বর।
হঠাৎ এমন এক অকল্পিত বৈচিত্র্যের ধাক্কায় আমার মুখে কথা সরল না খানিকক্ষণ। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছি। রমণীর কণ্ঠস্বর না, রমণীই বটে।
দু’হাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাসছে মুখ টিপে।
যশোমতী পাঠক। সহাস্যে যুক্তকরে নমস্কার জানালো।
আমার অবস্থা দেখে মহিলা আরো একটু জোরে হাসতে হুশ ফিরল যেন। ওদিক থেকে হন্তদন্ত হয়ে ত্রিপুরারি ছুটে এলো। অদূরে আমাদের গাড়িটার পাশে মস্ত আর একখানা ঝকঝকে গাড়ি দাঁড়িয়ে।
ত্রিপুরারিকে দেখে হোক, অথবা প্রায়-অপরিচিত একজনের কাছে এই লঘু বিস্ময় সৃষ্টির দরুন হোক, উৎফুল্ল হাসিটুকু মহিলা আর বাড়তে দিল না। ফলে, সপ্রতিভ হাসির আভাসটুকু সমস্ত মুখময় ছড়িয়ে থাকল। সবিনয়ে বলল, আপনি খুব মন দিয়ে দেখছিলেন। চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটালাম বোধহয়।
ত্রিপুরারি খুব হাসি-হাসি মুখে আমার দিকে চেয়ে আছে। পারলে আমার হয়ে সে-ই মাথা নেড়ে দেয়। চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটুক না ঘটুক, মহিলার এই অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে বিব্রত বোধ করছি। কেন, সে শুধু আমিই জানি। যুক্তকরে আনত হলাম, এবং ততোধিক বিনয়ে জবাব দিলাম, ব্যাঘাত কিছু ঘটাননি।….আপনিও বেড়াতে বেরিয়েছিলেন নাকি?
হাসিমুখে মাথা নাড়ল। আমার মুখের ওপর দু’চোখ নড়াচড়া করল একটু। হাসিটুকু হালকা গাম্ভীর্যের পর্দায় ঢাকতে চেষ্টা করে বলল, আমি এসেছিলাম রোগী দেখতে। এসে শুনলাম, রোগী ভর দুপুরেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়েছেন। তারপর সাবরমতীর ধারেও তাকে না দেখে ভাবলাম এখানেই আছেন।
ত্রিপুরারি হেসে মাথা নাড়ল, অর্থাৎ তার কত্রীর নির্ভুল ভাবনার তারিফ করল। আমার প্রচ্ছন্ন শঙ্কা ঠিক-ঠিক হাসি-চাপা দেওয়া গেছে কিনা বলতে পারব না। মহিলার পরের স্বাভাবিক প্রশ্নটা আরো অস্বস্তিকর। দু’চোখ তেমনি মুখের ওপর রেখেই জিজ্ঞাসা করল, এখন কেমন আছেন?
জবাব দেবার আগেই বিপাকে পড়ার ভয়ে ত্রিপুরারি ফস ফস করে বলে উঠল, খুব ভালো না, তবু কিছুতে বাড়িতে রাখা গেল না, বেরিয়ে তবে ছাড়ল।