যাই হোক, ঝাঁকে ঝাঁকে এসে সতীর্থদের এই শশব্যস্ত কর্তব্যের পালাও শেষ হল একসময়। হাঁপ ফেলে এরপর ত্রিপুরারিকে নিয়ে পড়লাম আমি। পাছে ওর কোনরকম সন্দেহ হয় এজন্যে সেটাই নিরাপদ মনে হল। ওর স্ত্রীর সেই কথা ক’টা কানের পর্দায় অস্বস্তির কারণ হয়ে আছে এখনো। বললাম, বেশ করে ঢাক পিটিয়ে সকলের কাছে প্রায় এখন তখন অবস্থা আমার বলে এসেছ মনে হচ্ছে?
আমতা-আমতা করে ত্রিপুরারি জবাব দিল,না মানে, অসুখ শুনে মিস পাঠক একটু ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে।
গম্ভীর মুখে বললাম, বড়লোকের ব্যস্ততার ধকল সামলানোও মুশকিল-ব্যস্ততার চোটে একেবারে ডাক্তার এসে হাজির হয়েছিল।
–হ্যাঁ, অসুখ শুনে পাঁচবার করে জিজ্ঞাসা করল কি অসুখ তারপর উঠে গিয়ে নিজেই ডাক্তারকে ফোন করে দিলে।
মুখের গাম্ভীর্য এবারে নিরাপদে একটু তরল করা যেতে পারে মনে হল।–সেজন্যেই তো বলছি, পার্টিতে যেতে না পারার কৈফিয়ৎ দেবার দায়ে তুমি আমাকে প্রায় শেষ করেই এনেছ।
ত্রিপুরারি লজ্জা পেল।–কি যে বলল! গেলে না দেখে ভদ্রমহিলা দুঃখ করতে লাগল। শুনলে এক্ষুণি তোমায় গিয়ে দেখা করতে ইচ্ছে করত। এর পর ত্রিপুরারি উল্টো দোষারোপ করল।–সাধে লোকে বলে বাঙালী বাবু, বাংলাদেশে থেকে থেকে তোমর যা হয়েছ। এখানে ওটুকু শরীর খারাপ আমরা কেয়ারই করি না–আর দু’দিনের মধ্যে তুমি বাড়ি থেকেই নড়লে না, পার্টিতেও গেলে না–জিজ্ঞাসা করলে তেমন কিছু হয়নি বলি কি করে? ভদ্রমহিলা যদি ভেবে বসে ইচ্ছে করেই কাটান দিলে!
আর বেশি ঘাঁটানো যুক্তিযুক্ত নয় মনে হতে সরব হাসির গর্ভে আলোচনার বিলুপ্তি ঘটাতে হল। কিন্তু হাসিটা স্বতঃস্ফূর্ত নয় এখনো, ওর বউ এরপর আবার কিছু মগজে না ঢোকালে বাঁচি।
০৩. ছুটির দিন
পরের দিনটা ছুটির দিন।
ত্রিপুরারির সঙ্গে বেড়াতে বেরুব আগেই স্থির ছিল। ও একটা গাড়ির ব্যবস্থাও করে রেখেছে।
কিন্তু মিথ্যের খেসারত এত সহজে মেটে না। ত্রিপুরারির বেরুবার কোনো উদ্যোগ বা লক্ষণ নেই। জিজ্ঞাসা করতে রায় দিল, এই শরীর নিয়ে বেরিয়ে কাজ নেই, আরো দু’চারদিন বিশ্রাম করে নাও। আছ তো এখন, তাড়া কি–
বিরক্তিকর। গত দু-দিনের অচলাবস্থা কোনরকমে বরদাস্ত করা গেছে, তার ওপর আজও এই কথা। প্রবল প্রতিবাদের আশ্রয় গ্রহণ ছাড়া গতি নেই। বললাম, যথেষ্ট বিশ্রাম নেওয়া হয়েছে, আর বিশ্রামে কাজ নেই। আর বিশ্রাম করতে বললে আমি একাই বেরিয়ে পড়ব বলে দিলাম। তাছাড়া খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার তো নেই, মোটরে ঘুরব–কিছু ক্ষতি হবে না। তোমার ছুটি তো আবার সেই সাত দিন পরে।
ত্রিপুরারি অনিচ্ছার কারণ দর্শালো, কিন্তু বউ যে বারণ করে দিল, অসুস্থ মানুষকে নিয়ে বেরুতে হবে না, বন্ধুকে শুয়ে ঘুমুতে বলল।
অগত্যা ওর সুপারিশ না করে ত্রিপুরারি-গৃহিণী সকাশে উপস্থিত আমি। যুক্ত হস্তে নিবেদন করলাম, বাংলা দেশের মেয়ে স্বামীর বন্ধুর প্রতি অকরুণ হয়েছে এমন নজির বড় চোখে পড়েনি, বন্ধুটি আপনাকে যত নিরীহ মনে করে ঠিক ততটাই আপনি নন বলে আমার ধারণা। দয়া করে আপনি ওর মাথায় কিছু ঢোকাবেন না, আর আরো একটু দয়া করে তরতাজা সুস্থ মানুষ দুটোকে একটু চরে বেড়াবার অনুমতি দেবেন, এই প্রার্থনা।
লজ্জা পেয়ে ত্রিপুরারি-গিন্নি হাসতে লাগল। আমি সেটাই ছাড়পত্র ধরে নিয়ে ফিরে এলাম। আর তারপর সন্দেহের উদ্রেক না করে ওকেও রাজি করানো গেল। যদিই দরকার হয় এজন্যে সঙ্গে দরকারী ওষুধ-পত্র নিতে পরামর্শ দিল ত্রিপুরারি।
সম্মেলনের অতিথিদের কাছের বা দূরের দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখবার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সেই আনুষ্ঠানিক দেখার মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়া আদৌ সম্ভব হয় না। দেখার তাড়াতেই সেই দেখার পর্ব শেষ হয়ে থাকে। ওই আনুষ্ঠানিক দেখার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করিনি। কারণ আমার এখানে থেকে যাওয়ার বা এখানকার এই দেখার পিছনে উদ্দেশ্য কিছু আছেই। এই দেখার সঙ্গে একটা মানসিক যোগ স্থাপন করাই বিশেষ উদ্দেশ্য।
প্রথম দর্শনে জায়গাটা যে ভালো লেগেছিল তার প্রধান কারণ সম্ভবত সাবরমতী। সাবরমতীর নীলাভ জল। শহরের মাঝখান দিয়ে সাবরমতীর ধারা দেখতে দেখতে মনটা কখনো সুদূর অতীতে উধাও হয়েছে, কখনো বা সদ্য বর্তমানে ঘোরা-ফেরা করেছে। আর ছোট বড় এত সেতু-বন্ধ দেখে দেখে ভিতরে ভিতরে কি এক সেতু রচনার প্রচ্ছন্ন উদ্দীপনা উঁকি-ঝুঁকি দিয়েছে।
লিখব কিছু। কিন্তু কি লিখব সেটা নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়। একটুও। ঘুরতে ঘুরতে কখনো ইতিহাস চোখ টেনেছে, কখনো বা সদ্যগত অতীত। এই দেখার মধ্যে আজকের বর্তমানটি শুধু একপাশে সরে দাঁড়িয়ে আছে। এই বর্তমানটাকে সাবরমতী যেন আমারই মতো দেখছে চেয়ে চেয়ে। না, আমার মতও নয়, আমার থেকেও শান্ত নির্লিপ্ত।
সাবরমতীর দু-ধারের এই জন-জীবনের কূল স্থাপন সুদূর অতীতের কাহিনী। প্রায় সাড়ে বারশ’ বছর আগের এই অরণ্য অঞ্চল ছিল। ভীলদের দখলে। ভীলপ্রধান আসা ভাল–তার নামে জায়গার নাম আসাওয়ল। তখন থেকে সারবতী এখানকার মানুষদের কৃষি বাণিজ্য শিখিয়েছে–সমৃদ্ধির আসন বিছিয়ে বসতে শিখিয়েছে!
এর পর মুসলমান কালের ইতিহাস। স্মরণীয় ইতিহাস নয়, কিছুটা রক্তপাতের ইতিহাস, কিছুটা বা ভাস্কর্য-শিল্পের ইতিহাস। গুজরাট-শাসক মজফফরের বিদ্রোহী পুত্র দুর্ধর্ষ তাতার খা পিতাকে বন্দী করেছিল এই আসাওয়লে। তারপর দোর্দণ্ডপ্রতাপে রাজ সিংহাসনে বসেছিল তাতার খাঁ।