আর তার পরদিন অর্থাৎ পার্টির দিন তো শরীর একটু বেশিই খারাপ। বেশি কি? পেটে গেলযোগ? কোনো ভদ্রমহিলার কাছে, বিশেষ করে যশোমতী পাঠকের মতো মহিলার কাছে রিপোর্ট করার মতো ভদ্রগোছের অসুখ নয় ওটা। ওদিকে দশবার করে গায়ে হাত দিয়ে দেখছে ত্রিপুরারি। জ্বরও বলতে পারি না। তাহলে বাকি থাকল বুকের দিকটা। ত্রিপুরারি জানল বুকে একটু-আধটু ব্যথা, যা নাকি আমার মাঝে-সাজে হয়, আর একটানা চব্বিশটা ঘণ্টা বিশ্রাম নিলেই আবার বিনা ঝামেলায় আপনা থেকেই দিবি সেরে যায়।
….ওষুধ!
ত্রিপুরারির ব্যস্ততা ঘন হবার আগেই তাড়াতাড়ি বলতে হল, ও একটু-আধটু ওষুধ আমার সঙ্গেই থাকে, ঘাবড়াবার মতো কিছু নয়। বলছি তো। তুমি আর দেরি কোরো না, পালাও এখন।
না ঘাবড়ালেও ত্রিপুরারির মন যে খারাপ হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পাটিতে আমার যাওয়া সম্ভব হল না বলে ঘুরে ফিরে বহুবার খেদ প্রকাশ করেছে। তার আগে মুহুর্মুহু বুকের খবর নিয়েছে। গাড়ি করে আধঘণ্টার জন্যে ঘুরে আসা যায় কিনা সেই প্রস্তাব অনেকবার করেছে। সঙ্গে ডাক্তার থাকলে যাওয়া চলে কিনা জিজ্ঞাসা করেছে– শেষে ওর বউয়ের কাছে চাপা ধমক খেয়ে হাল ছেড়েছে। মনিবদের এ-ধরনের অনুষ্ঠানে ওদের ব্যস্ত থাকতেই হয়, অতএব শেষ পর্যন্ত একাই যেতে হল তাকে।
বিকেলে নিশ্চিন্ত মনে বাগানে ঘোরাঘুরি করছিলাম। ত্রিপুরারি গৃহিণী এমনিতেই মিতভাষিণী, তার ওপর এই দ্বিতীয়বার মাত্র সাক্ষাৎ। মহিলা অতিথিপরায়ণ, কিন্তু তার সঙ্গে আড্ডা জমানো শক্ত। বহুবার শরীরের খবর নেওয়ায় অস্বস্তি বোধ করছিলাম। বিকেলের দিকে বেশ ভালো আছি এবং বাগানে একটু বেড়ালে আরো ভালো লাগবে শুনে সে নিশ্চিন্ত মনে ঘরের কাজে মন দিয়েছে। আর, একটু বাদেই পার্টি প্রসঙ্গ বা নিজের অসুস্থতার প্রসঙ্গ আমার মন থেকে সরে গেছে।
বাড়ির দরজায় গাড়ি দাঁড়াল একটা।
গাড়ি থেকে একজন স্থানীয় অপরিচিত লোক নামল। তার হাতে ছোট ব্যাগ আর স্টেথোস্কোপ। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াল, তারপর এগিয়ে এলো। আমি হতভম্ব। তাকে দেখা মাত্র মনে হল আমিই তার শিকার।
এগিয়ে এসে ভদ্রলোক ইংরেজিতে পরিচয় জিজ্ঞাসা করল, অর্থাৎ আমিই ওমুক কিনা। বোকার মতো ঘাড় নাড়তে চিকিৎসকের চোখে একটু নিরীক্ষণ করে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে আপনার? বুকে হঠাৎ কি-রকম ব্যথা বোধ করছেন শুনলাম? মিস পাঠক টেলিফোন করে এক্ষুনি আপনাকে একবার দেখে যেতে বললেন….
এ রকম বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হবে কে ভেবেছিল? বাংলা দেশের বাসিন্দা, চিকিৎসককে এত অবাঞ্ছিত আর বোধহয় কখনো মনে হয়নি। ওদিকে গাড়ির আওয়াজ পেয়ে দরজার কাছে ত্রিপুরারির স্ত্রী এসে দাঁড়িয়েছে। অতিথি এবং স্বামীর অন্তরঙ্গ অসুস্থ বন্ধুর প্রতি তারও কর্তব্যবোধ কিছু আছে। পরিস্থিতিগুণে আমি অসহায়।
মিথ্যার সতেরো জ্বালা। কি সব বলে গেছি বা বলতে চেষ্টা করেছি সঠিক মনে নেই। মোট কথা, ডাক্তারকে বোঝাতে হয়েছে শরীর সামান্য খারাপ হয়েছিল বটে কিন্তু এখন সুস্থই বোধ করছি। এখানে এসেই একটু অনিয়ম করা হয়েছে, একটু বেশি ছোটাছুটি করা হয়ে গেছে, খাওয়া-দাওয়ারও বেশি চাপ গেছে–দু’দিন একটানা বিশ্রাম নিয়ে এখন ভালই লাগছে। শুধু ভাল না, এখন আর কোনো গোলযোগের লেশ মাত্র নেই। ওঁদের এভাবে বিব্রত করার দরুন লজ্জিত, তাকে ধন্যবাদ, মিস পাঠককে ধন্যবাদ, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
কিন্তু শুধু ধন্যবাদ পকেটে পুরে ভদ্রলোক বিদায় নিল না কারণ, সে আমার অথবা আমার অসুখের তাগিদে আসেনি। এসে যার নির্দেশে ফিরে গিয়ে তাকে রিপোর্ট করতে হবে। অগত্যা বাগানের বেঞ্চে বসেই শরীরটাকে দু’পাঁচ মিনিটের জন্য অন্তত তার হেপাজতে ছেড়ে দিতে হল। ত্রিপুরারি-গৃহিণীও পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল। গুরুগম্ভার পর্যবেক্ষণ পর্ব শেষ করে প্যাড বার করে খসখস করে একটা প্রেসকৃপশন লিখে ডাক্তার বলল, এটা খেলে কালকের মধ্যেই আরোগ্য হয়ে যাবেন।
ডাক্তার বিদায় নিতে ত্রিপুরারি-গৃহিণীর মুখোমুখি হবার পালা। সাদা-মাটা মহিলা মৃদু মন্তব্য করল, খানিক আগেও যা ছিলেন তা থেকে তো অনেক ভালো মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, এক্ষুণি ওই ওষুধ-টষুধ আনার দরকার নেই….।
চোখের আড়ালে বা অধর কোণে কৌতুকের আভাস দেখলাম কি? একটু চুপ করে থেকে ত্রিপুরারি-গৃহিণী বলল, কিছু হয়ইনি বোধ হয়….। চলে গেল। আমার সন্দেহ হল কেমন, যতটা সাদাসিধে একে ভেবেছিলাম ততোটা যেন নয়।
.
আরো কিছু বাকি ছিল।
সন্ধ্যায় আর পরদিন সকালে সতীর্থরা অনেকেই আমাকে দেখে যাওয়া কর্তব্য বোধ করল। কিন্তু তাদের সহৃদয়তায় মুগ্ধ বলেই প্রায় নির্বাক আমি। বুঝলাম, কত্রীর আমন্ত্রণ রক্ষা করতে না পারার মত অসুখটা মোটেই খুব ছোট করে প্রচার করেনি ত্রিপুরারি। পার্টির সাহিত্যিক বন্ধুরা সকলেই জেনেছে আমি বেখাপ্পা রকমের অসুখে পড়ে গেছি। অতএব দলে দলে তারা এসেছে, দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছে, আর উপদেশ দিয়ে গেছে।
এ-ধরনের সাহিত্য-অধিবেশনে অভ্যাগতদের আসার পিছনে যেমন উৎসাহ, যাবার বেলাতেও তেমনি তাড়া। এলো, অধিবেশনের ফাঁকে ফাঁকে অনুষ্ঠাতাদের রুটিনমাফিক ব্যবস্থা অনুযায়ী হুড়মাড় করে দেখার যা আছে দেখা হয়ে গেল–অধিবেশন শেষ তো অমনি ফেরার তাগিদ। কটা দিন জীবনটাকে তাড়াহুড়োর মধ্যে রাখার বৈচিত্র্য থেকে কেউ বঞ্চিত হতে চায় না। কেউ স্বস্থানে প্রত্যাগমন করবে, কউ বা তেমনি দ্রুত তালে কাছাকাছির আরও দু’একটা নতুন জায়গা হয়ে ফিরবে। কাজেই আমার কাছে সতীর্থদের অবস্থান বা আমার শরীরের জন্য তাদের উদ্বেগ দীর্ঘস্থায়ী হল না–এই যা রক্ষা।