আমি কি আশা করেছিলাম? ওইটুকুই আশা করেছিলাম হয়ত। আশা করেছিলাম আর পাঁচজনের থেকে আমার এই প্রশংসার একটু মূল্য বেশি হবে, মহিলা খুশি হবে। আর হয়তো আশা করেছিলাম, পাশের শূন্য আসনটি দেখিয়ে আমাকে বসতে বলবে। তার বদলে আধা-ভাঙা আসরের যন্ত্রসঙ্গীত যে বেশি মনোযোগের বিষয় হবে, ভাবিনি।
অতএব আমি কি করলাম, পাঠক সহজেই অনুমান করে নিতে পারেন। পাঁচ-সাত-দশ সেকেণ্ড বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। সেটুকুই দীর্ঘ এবং অশোভন মনে হতে বোকার মতো হাসলাম একটু। তারপর আবার নমস্কার জানিয়ে পিছনে ফিরে ত্রিপুরারির পাশে এসে বসলাম। তারপর মনে মনে নিজের উদ্দেশে কটক্তি করতে থাকলাম। মর্যাদা-বোধ আহত হলে কখনো কখনো সেটা ঠুনকো বস্তুর মতই ভেঙে পড়তে চায়।
কিন্তু ত্রিপুরারির সবুর সয় না, ফিরে আসা মাত্র সাগ্রহে চড়াও হল আমার ওপর।–তুমি হঠাৎ উঠে কি বলে এলে?
রাগটা অকারণে ত্রিপুরারির ওপরেই ঝাড়তে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু নিজের দোষে বোকা বনেছি, ওর দোষ কি। বললাম, গানের প্রশংসা করে এলাম।
খুশি হল খুব? কি বলল?
-ধন্যবাদ দিল।
নিজেকে সান্ত্বনা দেবার দায়ে এদিক-ওদিক চেয়ে দেখছি–বাংলা সাহিত্যের অধিবেশন বলে আমার মতো ধুতি-পাঞ্জাবির সংখ্যাই বেশি, অতএব মহিলার চিনতে না পারাটা আশ্চর্য কিছু নয়। কিন্তু অনুভূতি সব সময় যুক্তি ধরে চলে না। ভিতরে ভিতরে অস্বস্তিজনক কিছু একটা বিধছেই। কেবলই মনে হচ্ছে মস্ত ধনী কন্যাকে গায়ে পড়ে প্রশংসা করতে যাওয়ার মতো হয়েছে ব্যাপারটা।
ত্রিপুরারি তার লেডির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠার খোরাক পেয়েছে যেন। বাজনা শোনাটা ওর কাছে বিলাপ শোনার মতো। সাগ্রহে ঘুরে বসে বলল, শুধু গান? ও-দিকে এম-এ পাস, জানো? আজ না হয় এখানে মেয়েদের মধ্যে বি-এ এম.-এ’র ছড়াছড়ি–বিশ বছর আগে তো হাতে গোণা যেত। তাছাড়া, আরো অনেক রকমের গুণ আছে মহিলার, বক্তৃতা করে চমৎকার। কিছুদিন থেকে যাও যদি তোমাকে শোনাব। তারপর এখানকার লেডিস ক্লাবের সে-ই ফাউণ্ডার-প্রেসিডেন্ট-বিশ বছর আগে তারই চেষ্টায় হয়েছিল। গোড়ায় অনেকে আপত্তি করেছিল, এখন লেডিস ক্লাব জম-জমাট। আর এবারে তো পুরুষদেরও টেক্কা দিয়ে একেবার চেম্বারের প্রেসিডেন্টই হয়ে বসেছে।
আমি বাজনায় মন দিয়েছি। দিই না দিই বাজনা শোনায় গুরুগম্ভীর নিবিষ্টতা আনতে চেষ্টা করেছি। মনে মনে নিজেকে যে প্রত্যাখ্যাত গোছের ভেবে আহত, এত গুণের ফিরিস্তি তার কানে আরো পীড়াদায়ক। অন্তত তখনকার মতো। জিজ্ঞাসা করলাম, এ-রকম শিক্ষিতা হয়েও তোমাকে ঘোষবাবু বলে কেন?
ত্রিপুরারি জবাব দিল, এখানে সকলেই ওই রকম বলে।
.
পরদিন সুন্দর একটি ছাপা কার্ড পেশ করল ত্রিপুরারি। আমন্ত্রণ লিপি, সোনা-রঙের ছাপার নিচে সোনালী অক্ষরে যশোমতী পাঠকের নাম। পাঁচ দিনের অধিবেশন-শেষে প্রবাসী অতিথিবর্গের সম্মানার্থে পার্টি। শ্ৰীমতী পাঠক তার বাড়িতে ব্যক্তিগত ভাবে এই পার্টি দিচ্ছে। স্থানীয় প্রধান বা প্রধানার তরফ থেকে এ-ধরনের পার্টির ব্যবস্থা নতুন কিছু নয়।
এও যে আর একটা বাড়তি অবজ্ঞার মতো লেগেছে সেটা ত্রিপুরারিকে বুঝতে দেবার ইচ্ছে ছিল না। আমন্ত্রণ-লিপি দেখে নিয়ে খুব সাদাসিদেভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, তা কত্রীর হয়ে তুমিই নেমন্তন্ন করে বেড়াচ্ছ বুঝি?
একটা সুবিধে, আয়-ব্যয় জমা-খরচের জটিলতায় ত্রিপুরারির যত মাথা খোলে, এসব সামাজিক ব্যাপারে ততো নয়। এই প্রশ্নের ফলে ওর মনে এতটুকু ছায়াপাত হোক, সেটা চাইনি তার ভিন্ন কারণ। আমার মেজাজের আঁচ পেলে সেটা ওর পক্ষে বিড়ম্বনার ব্যাপার হবে। হয়তোবোঝতে বসবে আমিই ভুল করেছি। তাই কিছু খেয়াল না করার মতো করেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম-ত্রিপুরারি খেয়াল করলও না।
জবাব দিল, বাড়ির গায়ের গেস্ট কোয়ার্টার্সের সব সাহিত্যিকদের নিজেই বলেছে, আর এদিককার দু-দশজন যাদের বলা হচ্ছে, তাদের ভার আমার ওপর। চিঠি নিয়ে এখন ক’ জায়গায় ছোটাছুটি করতে হবে, ঠিক নেই।
যাক, নিশ্চিন্ত। মনের তলায় শুধু একটা অস্বস্তি, আমার কোনো আচরণে ত্রিপুরারি না আঘাত পায়। যার জন্যে ছোটাছুটি করে তার আনন্দ, তার সঙ্গে ওর রুটির যোগ, চাকরির যোগ, ভবিষ্যতের যোগ। আমার আচরণে ও এদিক থেকে কিছুমাত্র সচেতন হলে আমার লজ্জার সীমা থাকবে না। মহিলার গেস্ট কোয়ার্টার্সে আমি থাকিনি ত্রিপুরারির অন্তরঙ্গতার টানাপোড়েনে পড়ে। কিন্তু আমি যে এখানকার দু-দশজনের একজন নই, আমিও যে বহিরাগত অতিথি –সেটা ত্রিপুরারির মনে না থাকুক, ওই মহিলার মনে না থাকাটাও ঠিক বরদাস্ত হবার কথা নয়। গত দিনের ব্যবহারের পর এই নিজে নিমন্ত্রণ না করাটা শুধু কর্মচারীর বন্ধু বলে, এছাড়া এই অবজ্ঞার আর কোন কারণই মনে আসেনি আমার।
অতএব শরীরটা সেই দিনই আমার খারাপ হল একটু। কত্রীর বাড়ির নেমন্তন্ন দুদিন পরে, তাই ত্রিপুরারির কিছু আঁচ করা সম্ভব হল না। পরদিন স্ব-ঘটিত শরীর-খারাপের মাত্রা আরো একটু বাড়াতে হল। ত্রিপুরারিকে জানালাম, মাথা ভার, গা ম্যাজ ম্যাজ করছে অতএব সাহিত্য-সম্মেলনের সেটা শেষ দিন হলেও যাই কি করে ত্রিপুরারি নিজেই ডাক্তারী করল, ডায়েটিংয়ের ব্যবস্থা করে দিল, মাথা ধরার বড়ি রেখে গেল। ওকে তো বেরুতেই হবে, মাথার ওপর অনেক দায়। খাওয়ার ওপর যেমন অত্যাচার চলেছে ক’দিন ধরে ডায়েটিংয়ে আমার আপত্তি নেই। মাথা ধরার ওষুধ অবশ্য কাজে লাগানো গেল না। মাথা কিছু খাটাতে হচ্ছে, তাই মাথা একটু আধটু ধরা বিচিত্র ছিল না। কিন্তু না ধরলে কি আর করা যাবে।