সমর ঘোষাল মাথা নেড়ে সায় দিল, অর্থাৎ সে-রকমই লাগছে। তারপর নিরীহ প্রশ্ন, শেরিংকে ডেকে যাচাই করে নেব?
–যা বললাম, বসে করবে না এইসব করবে?
জবাবে আগে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল।–তা করতেই বা হাত উঠছে কই, এখন ধরো তোমার যদি কারসিয়ঙ বা দার্জিলিং-এ চাকরি হয়, আমার ভালো লাগবে? এখন তো ভাবনা আরো বাড়ল, তোমাকে কুমারী ভেবে ভালো লোকও যদি বেশি কাছে আসতে চায় তাকে দোষ দেওয়া যাবে না।
সমর ঘোষাল আশা করেছিল এতটা বলার পর ওই ফর্সা কপালে ছোট হলেও একটা সিঁদুর টিপ আর সিঁথির লাল আঁচড় আর একটু উজ্জ্বল দেখবে। এ কদিনে ওটুকু ভারী পছন্দের হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু দেখা গেল না।
তিন দিনের মধ্যে এই একই প্রসঙ্গে আবার একটু মজার যোগাযোগ। অতসী এখানকার সব থেকে নামকরা মেয়ে স্কুলে এসে হাজির। ব্যাগে দরখাস্ত। নারভাস হবার মেয়েই নয় সে। অফিসের কেরানীর কাছে আগে প্রিন্সিপালের নাম জেনে নিল, মিসেস হৈমন্তী খাসনবিশ। তারপর বেরিয়ে এসে স্লিপে নিজের নাম লিখতে গিয়েই ভুল। লিখেছে শ্রীমতী অতসী গাঙ্গুলি। বিরক্তির একশেষ। দ্বিতীয় স্লিপে শ্রীমতী অতসী ঘোষাল লিখে বেয়ারার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিল। দুতিন মিনিটের মধ্যেই ডাক এলো।
বরাতটাই বোধহয় খারাপ আজ। ঘরে পা দিয়ে নিজের অগোচরেই একটু অভব্যতা করে ফেলল। কারণ স্কুলের কোনো প্রিন্সিপালের এমন দশাসই চেহারা তার কল্পনার। বাইরে। পোশাক পরিচ্ছদও একটু বিচিত্র ধরনের। বিশাল টেবিলের ওধারে মস্ত একটা রিভলভিং চেয়ার জুড়ে বসে অল্প অল্প দোল খাচ্ছেন। পরনে সাদা সিল্কের শাড়ি, গায়ে কাজ করা সিল্কের সাদা ব্লাউস, তার ওপর সাদা কাজ করা খয়েরি রঙের ঢাউস একটা দুক-খোলা এপ্রনগোছের হাফ-হাতা লং কোট। মাথায় অবিন্যস্ত সাদা-কালো চুলের বোঝা। নাকের নিচে ঘন লোম, দুই গালেরও অনেকটা আর হাতের কনুই থেকে যেটুকু চোখে পড়ে তা-ও ঘন লোমে বোঝাই। মুখের ছাদ পুরুষালি। শাড়ি পরা না থাকলে বা খোলা এপ্রনের মাঝখানে বক্ষের বিপুল স্তন-ভারের আভাস না দেখা গেলে মেয়ে কি পুরুষ ভেবে দুচোখ আরো বেশি বিভ্রান্ত হত।
.
ইয়েস? আই অ্যাম মিসেস খাসনবিশ, সীট ডাউন প্লীজ! হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?
অতসী ধরেই নিল সে ফেল। মানে মানে এখন সরে পড়লেই হয়। সেটা করা আরো বিসদৃশ। দুহাত জুড়ে একটু বেশি আনত হয়ে শ্রদ্ধা জানালো। মহিলার দিক থেকে তার কোনো জবাব মিলল না। বিশাল টেবিলের এ-ধারের চেয়ারে মুখোমুখি বসল। কিন্তু তার চোখে চোখ রাখতে মনে হল, উনি যেন প্রথম দর্শনে ওর ভেবা চ্যাকা খাওয়া মূর্তি দেখে বেশ মজা পাচ্ছেন।
অতসী সবিনয়ে জানালো, সে একটা চাকরির চেষ্টায় এসে তাকে বিরক্ত করতে বাধ্য হয়েছে, এই এই কোয়ালিফিকেশন, যদি কোনো সুবিধে হয়।
মিসেস খাসনবিশ ঝুঁকে আর একবার স্লিপের নামটা দেখলেন। গলার স্বর এমনিতেই ফ্যাসফেসে, প্রশ্ন আরো রুক্ষ। এম, এ অ্যান্ড বি, এ ফ্রম হোয়াট য়ুনিভার্সিটি?
–ক্যালকাটা য়ুনিভার্সিটি?
–দেন হোয়াই হিয়ার?
অতসী সবিনয়েই জানালো, হাসব্যান্ড এখানকার য়ুনিভার্সিটিতে জয়েন করেছেন তাই সে এখানে। মাত্র আট দশদিন হল তারা এখানে এসেছে।
তখুনি সেই সিঁদুর প্রসঙ্গের পরোক্ষ যোগাযোগ। হাসব্যান্ড শুনে প্রিন্সিপাল লোমশ দুই হাত টেবিলের ওপর রেখে সামনে ঝুঁকলেন, থলথলে মুখের দুচোখ তার দিকে নিবিষ্ট হল। তারপর মন্তব্য, ইউ আর ম্যারেড দেন…! ক্রিশ্চিয়ান?
–না হিন্দু।
শুনে কৌতূহল বাড়লো যেন।–কতদিন বিয়ে হয়েছে?
–মাস দুই আগে…।
থলথলে মুখে হাসির আভাস একটু। আবারও তেমনি ঝুঁকে বসেই নিরীক্ষণ করলেন একটু। তারপর সোজা হয়ে বসে বললেন, আই অ্যাম সরি, ক্লাস ইলেভেন টুয়েলভ-এর জন্য আমার একজনই ইকনমিকস-এর টিচার আছে। তার রিটায়ারমেন্টের এখনো বছর দুই বাকি
ফ্যাসফেসে গলার স্বর একটু সদয় মনে হল অতসীর। দ্রুত ভেবে নিল, দুটো বছর সে যে কোনো নিচু ক্লাসেও পড়াতে প্রস্তুত, বলবে কি বলবে না। কিন্তু তার আগেই মিসেস খাসনবিশ বললেন, বাট আই মে ট্রাই টু হেল্প ইউ..জলপাইগুড়ির গার্লস স্কুলের হেডমিসট্রেস আমার বন্ধু, শী রিগারডস মি, তার স্কুলে ইকনমিক্স-এর একটা লিভ ভেকেন্সির পোস্ট খালি আছে শুনেছি, তাঁর ইকনমিক্স টিচারের টিউবারকিউলোসিস ধরা পড়তে সে লং লিভ এ আছে, তিন চার দিন আগে হেডমিসট্রেস আমাকে ফোনে জিগেস করেছিলেন, আমার চেনা-জানা কেউ আছে কিনা, আপনি
অতসী তক্ষুনি বলে উঠল, আমাকে আপনি বলে লজ্জা দেবেন না
খুশি।–অলরাইট, গো অ্যান্ড সি হার, এর মধ্যে কাউকে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিনা জানি না, যদি না নেওয়া হয়ে থাকে, ইউ হ্যাভ ফেয়ার চান্স…ইউ মে রেফার মি।
মহিলা এতটা সদয় হতে পারে আশাতীত। জলপাইগুড়িতে চাকরি হলে এখান থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করা জল-ভাত ব্যাপার। অতসী আর একটু ঝুঁকে কৃতজ্ঞতায় টুপুটুপু সুরে বলল, ইউ আর সো কাইন্ড ম্যাডাম, যেখানেই চাকরি করি দু বছর বাদে হলেও আমি এখানে আপনার আশ্রয়ে আসব এই আশা নিয়ে যাচ্ছি, আমার সঙ্গে অ্যাপ্লিকেশন আছে, যদি অনুমতি করেন তো এখনই সেটা রেখে যেতে পারি…।
থলথলে মুখের খাঁজে খাঁজে হাসি উছলে উঠল।–্যু ইয়ার..এ লং টাইম মাই ডিয়ার, হাউ এভার ইউ রিয়েলি দিস বিজনেস…অ্যান্ড দ্যাটস গুড। লোমশ হাত বাড়িয়ে দিলেন, লেট মি হ্যাভ ইট।