সমর ঘোষাল এবার চাপা গলায় বলে উঠল, এ-রকম করলে লোকটা পালাবে যে!
অতসীর গম্ভীর মুখের দুই ঠোঁটে এবারে একটু হাসির ফাটল। বলল, বেশি বাড়লে তোমারও ওই দশা হবে।
সমর ঘোষালের মনে হয়েছে এই ব্যক্তিত্বের মাধুর্যটুকুই দুচোখ ভরে দেখার মতো।
.
দিন সাতেকের চেষ্টায় সব-কিছু চলনসই। মনে হল অতসীর। বড় সমস্যা ছিল রান্না নিয়ে। কারণ কলকাতায় যেভাবে দিন কেটেছে, অতসীর কখনো রান্নাঘরে ঢোকার সময় হয়নি। এ-ব্যাপারে তার সহজাত ঝোঁকও নেই। ওপরতলার ভদ্রলোক বলে দিয়েছিলেন, বাঙালি বাড়িতে কাজ করে করে শেরিং মোটামুটি রান্নাও শিখেছে। দুতিন দিন য়ুনিভার্সিটি-ক্যান্টিন থেকে খাবার আনিয়ে লাঞ্চ ডিনার সারা হয়েছে। কিন্তু এ-ব্যবস্থা কদিন আর চলতে পারে, তাছাড়া ক্যানটিন খুব কাছেও নয়। শেরিং কলের মানুষ, তাই কর্তীর কোনো হুকুমে তার মুখে বিরক্তির ছায়া নেই। আর তার দুচোখও এখন সর্বদা মাটির দিকে। অতসী লক্ষ্য করেছে সকালের ব্রেকফাস্ট চা টোস্ট ডিমসেদ্ধ বা ওমলেট তার আয়ত্তের মধ্যে, বিকেলেরটা এপর্যন্ত পরখ করা হয়নি, কারণ ক্যানটিনে সে-সময় লুচি-পুরি তরকারি আলুর দম ভালোই মেলে। অতসী হুকুম করা মাত্র কলের মানুষটা আশ্চর্যরকম তৎপর হয়ে তড়িঘড়ি নিয়ে আসে। অতসী এরপর তাকে রান্না ঘরে ঠেলেছে। জিগেস করা মাত্র সে বলেছে বাঙালী রান্না সে সবই জানে। কিন্তু তার জানার বহর দেখে প্রথম দিনই সমর ঘোষালের দুচোখ কপালে। ভাতে খুব ত্রুটি নেই, কেবল সেদ্ধ একটু কম, ডালের সঙ্গে ভাজাও ঠিকই আছে, কিন্তু ডালটাকে ফ্রায়েড ডাল বলা যেতে পারে। তরকারি যা পাতে পড়ল সেটা একটা স্বাদশূন্য রকমারি আনাজের ঘাট, মাছের ঝোল একদিকে আর কড়া ভাজা মাছের খণ্ড আর একদিকে। তা-ও ছনছনে ঝাল।
প্রথম দিনের রান্না কিছুটা চালান দিয়েই হতাশ গলায় সমর ঘোষাল বলে উঠেছিল, এবারেই হয়ে গেল, দুজনেরই আলসার অনিবার্য।
অতসী কিন্তু মোটামুটি খেতে পেরেছে। ধমকের সুরে বলেছে, একটু ধৈর্য ধরো তো, বলে দিলে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু সাহেবের খাওয়া দেখে শেরিঙের নিজেরই খটকা লেগেছে। চার ভাগের তিন ভাগ তার পাতে পড়ে। নিজের পায়ের দিকে চোখ নামিয়ে মেমসাহেবের কাছে নিবেদন করেছে, মিট-কারি, এগ কারি সুপ-এ-সব হলে সে ভালো খানা পাকাতে পারে।
দেখা গেল এ-গুলো সত্যিই চলনসই। কিন্তু দুবেলা এই একই জিনিস কাহাতক চলে। দুদিন না যেতে বিরক্ত হয়ে সমর ঘোষাল বলে উঠেছে, শোনো, আমার জন্য সব কেবল সেদ্ধ করে রাখতে বোলো, আমি সেদ্ধ-ভাত খাব! ডাল তরকারি সুক্তোর স্বাদ তো ভুলতেই বসেছি।
শোনামাত্র অতসীর তপ্ত মুখ।-আমি যা পারি না তা নিয়ে খোঁচা দিয়ে লাভ কি, তোমার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, দেখেশুনে একজন রাঁধুনি বিয়ে করলেই ভালো। করতে। রোসো দুদিন, সব ঠিক হয়ে যাবে।
দুদিন যেতে দেখা গেল সত্যি অনেকটাই ঠিক হয়ে এসেছে। ডাল তরকারী মাছ সবই মুখে দিতে পারছে। কি ব্যাপার? না, অতসী সোজা গিয়ে ওপরতলার গৃহিণীর শরণাপন্ন হয়েছিল। সমস্যার কথা শুনে তিনি নেমে এসে হাতে ধরে শেরিংকে এই তিনটি জিনিস রাঁধতে শিখিয়েছেন। এখন নাকি সুলে রাঁধতে শেখাচ্ছেন। অতসী হেসে সারা, মহিলা যা দেখান যা শেখান শেরিঙের মাটির দিকে চোখ, শেষে ধমক খেয়ে বুঝেছে রান্না শেখার জন্য তার দিকে তাকানো যেতে পারে।
সাত আটদিন যেতে অতসী নিজের ভাবনা ভাবতে বসল। স্কুলের চাকরি একটা জোটাতে হবে। কেবল এখানে কেন, কালিম্পং কারসিয়াং দার্জিলিং-এ যেতে হলেও তার আপত্তি নেই। মেয়েদের হস্টেলে থাকবে, শনি রোববারে বা অন্যান্য ছুটির দিনে চলে আসবে। এ কটা দিন যেতে সমর ঘোষালও মোটামুটি সুস্থির। ঘর গোছানো আর সংসার পাতা নিয়ে অতসীর ফরমাশের পর ফরমাশ, অন্যদিকে ছাত্র পড়ানোর প্রস্তুতি–কোনো দিকে তাকানোর অবকাশ ছিল না। পরামর্শের জন্য অতসী তাকে টেনে এনে সামনে বসালো–ইংরেজিটা তুমি আমার থেকে ভালো জানো যখন নিজে আর কষ্ট করি কেন, আমার বায়োডাটা দিয়ে দরখাস্তের জেনারেল একটা খসড়া করে দাও, তারপর চেষ্টা শুরু হোক, এ কটা দিন তো নিজের তালেই কাটালে—
মুখের দিকে চেয়ে এই প্রথম কি একটু ব্যতিক্রম চোখে পড়ল সমর ঘোষালের। উঠে এসে সামনে দাঁড়ালো। –দেখি দেখি! দুহাতে মাথাটা ধরে সামনে টেনে নিবিষ্ট চোখে কিছু দেখার চেষ্টা, সঙ্গে মন্তব্য, একটা মাইক্রোসকোপ থাকলে ঠাওর করা যেত
অতসীর গলা দিয়ে প্রায় আর্তনাদের মতো বেরুলো, কি–পাকা চুলটুল নাকি?
সমর ঘোষাল হাসতে লাগল, বলল, না, লাল আঁচড়ের মতো একটু কিছু চোখে পড়েছে, এ কদিন খেয়ালই করিনি, কপালে এমন সুন্দর টকটকে সিঁদুরের টিপ পরতে, সিঁথির সিঁদুরও আগুনের শিখার মতো জ্বলজ্বল করত–সে-সব এরই মধ্যে বাতিল!
যাও! অতসী দুহাতে তাকে ঠেলে সরালো। কলকাতায় তোমার মায়ের পছন্দে ও-রকম পরতে হত, এখানে আমি ও-রকম গেঁয়ো সেজে বেড়াবো?
-সঙ কেন, তোমার ফর্সা কপালে অমন টকটকে সিঁদূর টিপ আমার তো খুব ভাল লাগত, আর মনে হত একমাত্র আমি ছাড়া আর সক্কলের বেশি কাছে আসা নিষেধ।
অতসীর মুখে রাগত হাসি।আর এখন কি মনে হচ্ছে, দুহাত বাড়িয়ে সকলকে আমি কাছে ডাকছি?