শোনার পর সমর ঘোষালের দুচোখে সত্যিই তিমির তৃষ্ণা।
.
বিয়ে হয়ে গেল। অতসী গাঙ্গুলি অতসী ঘোষাল হল।
এর পরের সবকিছুই যেন তাদের ইচ্ছার অনুকূলে সাজানো। তাদের বলা ঠিক হল না, অতসীর। সমর ঘোষাল যুগপৎ খুশি এবং অবাক হয়ে দেখছে পরের সব পদক্ষেপ অতসীর হিসেব মতোই দুজনকে বাস্তবের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে।
…ভালো মতো একটু নড়া-চড়া করতে দেখা গেল অতসীর কথা মিথ্যে নয়, কলেজ-যুনিভার্সিটির চাকরি যেন তার জন্য হাঁ করেই ছিল। মফঃস্বল কলেজের সরকারী চাকরি পছন্দ হল না, নর্থবেঙ্গল যুনিভার্সিটিতে লেকচারারের পোস্টটাই পছন্দ। এখানকার শ্রদ্ধেয় ইংরেজির প্রোফেসারও এই চাকরিই নিতে পরামর্শ দিলেন। আর বললেন, এ-লাইনেই এলে যখন যত তাড়াতাড়ি পার ডক্টরেটটা করে নাও, নইলে এগোতে অসুবিধে হবে।
সমর ঘোষাল তারই আন্ডারে রিসার্চ করবে স্থির করেই রেখেছিল। ভদ্রলোকের খবই স্নেহের পাত্র সে, খুশি হয়েই রাজি হয়ে গেলেন। কয়েক দিনের আলোচনায়। রিসার্চের বিষয়ও স্থির করে অতসীকে নিয়ে সে শিলিগুড়ি রওনা হয়ে গেল। প্রোফেসার দূরে থাকলেও অসুবিধে কিছু হবার কথা নয়। মাঝে মধ্যে কলকাতায় আসতে হবে, ভেকেশনগুলো আছে, এটা কোনো বাধাই নয়।
য়ুনিভার্সিটি ক্যামপাস কলেজ থেকে অনেকটাই দূরে। এই এলাকায় ঘর আগেই ঠিক করে রেখে গেছল। দোতলা বাড়ির একতলায় দুখানা বড় ঘর, কিচেন বাথ ইত্যাদির আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাও অপছন্দের নয়। কলকাতার ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে এ রকম ফাঁকা জায়গায় এসে অতসী খুশি। শিলিগুড়ি শহরেও শুনেছে লোকের মাথা লোকে খায়, শহরের ভিতর দিয়ে আসার সময় যেটুকু দেখেছে তাতেই হাঁপ ধরার দাখিল। এখানে এসে ওঠার পর একটু কেবল খুঁতখুঁতুনি থেকেই গেল। বড় হলেও ঘর মাত্র দুখানা। এরপর লোকজন আসা শুরু হলে তাদের কোথায় বসাবে কি করবে? যাক, অতসী কোন কিছুতে ঘাবড়াবার মেয়ে নয়, পুরুষের বুদ্ধিতে যেটুকু হয়েছে তাই যথেষ্ট, পরে দেখা যাবে।
নতুন একটা সংসার পেতে বসার ঝামেলা যে কত, দেখে প্রায় অসহায় অবস্থা সমর ঘোষালের। ব্যবস্থা করা আর গোছগাছের ঠেলায় অতসীর ফুরসৎ তো নেই-ই, নতুন কর্তাটিরও নাজেহাল দশা। তার ওপরেও ফরমাশ বর্ষণ হয়েই চলেছে, এটা আনো ওটা আনো, এটা করো ওটা করো। অতসীরও তো নতুন সংসারই, সব একেবারে মনে পড়ে না। ফলে যা একবারে হয়ে যায় তার জন্য তিন বার করে। ছোটাছুটি। আবার ফরমাশ অনুযায়ী যা আনে তার বেশিরভাগই পছন্দ হয় না, নাক-মুখ কুঁচকে বলে ওঠে, এ-রকম আনলে কেন–ও-রকম পেলে না? এ মা, প্লাস্টিকের এত বড় বালতি আনতে বলেছি তোমাকে! দেখ কাণ্ড, কিচেন বাথরুম টয়লেটের জন্য তিনটেই লাল মগ–কোনো বুদ্ধি যদি থাকত, বদলাবদলি হয়ে গেলে টের পাবে!
ঘাম ঝরা নাক-মুখ কোঁচকানো মূর্তিখানা চোখে মিষ্টিই লাগে সমর ঘোষালের, তাই বিরক্তির বদলে হাল ছেড়ে বসে পড়ে।আমার দ্বারা আর কিসসু হবে না, আমার বদলে ওই ছেলেটার ওপর তোমার সর্দারি চালাও।
ছেলে বলতে ওপরতলার ভদ্রলোকের ঠিক-করা কাজের লোকটা। জোয়ান, গাঁটা-গোট্টা চেহারা, ভাবলেশশূন্য পালিশ করা মুখ, নাম শেরিং। এই তিন দিন ধরে তার নীরব দর্শক আর কলের পুতুলের মতো হুকুম তামিলের ভূমিকা। বাংলা বলতে পারে না, ভাঙা-ভাঙা হিন্দি বলতে পারে এবং বোঝে। গত তিন দিন যাবত এই বংগালী মেমসাবটি তার মনোযোগী দ্রষ্টব্যের একজন। অতসী চাপা গলায় গজগজ করে উঠল, একটু গুছিয়ে নিয়েই ওকে আমি তাড়াব, সব টানা-হেঁচড়া করতে করতে কতবার করে বুকের কাপড় কাঁধের কাপড় সরে যাচ্ছে, ওর হাঁ-চোখ দৃষ্টি তখনো নড়ে না–
একটা সিগারেট ধরাবার ফাঁকে সমর ঘোষাল আড়চোখে লোকটাকে দেখে নিয়ে বলল, বুক-কাঁধের কাপড় তাহলে আর একটু বেশি-বেশি সরাও, দেখবে ও খুশি হয়ে আমার থেকে ঢের বেশি পছন্দ মতো তোমার সব কাজ করে কম্মে দেবে।
কিছু একটা উদ্দেশ্য নিয়ে অতসী বড় স্টিল ট্রাঙ্কটার ও-ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠাট্টার জবাবে গম্ভীর মুখে দেখে নিল একবার তারপর লোকটার দিকে ফিরল।-শেরিং!
দুচোখ তার মুখের ওপরেই ছিল। গলা দিয়ে বিড়বিড় শব্দ বার হল, জি মেমসাব
পাঁচ-পাঁচটা বছর মাড়োয়ারী বাড়িতে মাস্টারী করার ফলে অতসী হিন্দিটা মোটামুটি রপ্ত করেছে। আঙুল দিয়ে ট্রাঙ্কটার উল্টো দিক দেখিয়ে হুকুম করল, ইধার আও।
সমর ঘোষাল বুঝল ট্রাঙ্কটা যেখানে ছিল সেখানে রাখা আর পছন্দ নয়, অন্যত্র সরাবে। এ-রকুম ওলট-পালট করেই চলেছে। শেরিং এগিয়ে এসে যথাস্থানে দাঁড়ালো। ভাবলেশশূন্য দুচোখ তখনো কর্রীর মুখের ওপর।
-আপনা দো আঁখো জমিন পর রাখো।
এবারের হুকুম শুনে সমুর ঘোষাল এস্ত একটু। লোকটা তাই করল। দুচোখ নিজের পায়ের দিকে নামালো।
–আব উধার পাকড়ো–আঁখো মাৎ উঁচানা
ঝুঁকে অতসী নিজে ট্রাঙ্কের এ-দিকের আংটা ধরল।–লে আও।
ধরাধরি করে ঢাউস ট্রাঙ্ক পছন্দের জায়গায় রেখে অতসী সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কাজ সেরে লোকটাও মুখ তুলেছিল, কিন্তু সমর ঘোষাল আশ্চর্য হয়ে দেখল, কীর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই দুচোখ আবার মাটির দিকে।
আব তুমি বাহার যা কে ঠায়রো, হম বোলায়গা।
ঘর ছেড়ে বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। দৃষ্টি তার পরেও পায়ের দিকে।