এবারে সমর ঘোষাল এত জোরে হেসে উঠল যে নিজের ঘরে বসেও অতসী সচকিত একটু।
-তাহলে চলো উঠে পড়া যাক, এই দিনে ঘরে বসে আর ডাল ভাত-মাছ। ভালো লাগবে না।
স্নান সারাই ছিল, খুশি হয়ে অতসী দশ মিনিটের মধ্যে তৈরী হয়ে এলো। তার এই অনাড়ম্বর ছিমছাম ভাবটা শুরু থেকেই সমর ঘোষালের পছন্দ। আর কেউ হলে কম করে আধ-ঘণ্টা সময় নিত।
পার্কস্ট্রীটে এসে একটা ভালো রেস্তোরাঁ বেছে নিল। খাওয়ার ফাঁকে টুকটাক ভবিষ্যতের কথা শুরু হল। সমর ঘোষাল প্রস্তাব করল, তাহলে মা-কে বলি, পুরুত ডেকে যত তাড়াতাড়ি হয় দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলুক?
অতসী বলল, পুরুত ডেকে পিঁড়িতে বসে বিয়ে আমার পছন্দ নয়, তার থেকে রেজিষ্ট্রি বিয়ে হোক।
-সে কি! কেন?
অতসী খুব অনায়াসে বলে গেল, কেন বুঝতেরছ না? বড় বোনের বিয়ে দিতে গিয়েই বাবা প্রায় নিঃসম্বল, ছোট বোন দুটো এখন কলেজে আর ভাইটা স্কুলে পড়ছে। ঘটার বিয়ে হলে লোকজনের ভিড় হয়ই, আর কনের সঙ্গে তারা আর কি ঘরে আসছে তা-ও লক্ষ্য করে। তুমি যখন বড়লোকের সালঙ্কারা কন্যা ঘরে এনে তুলছ না, আমার দিকের দৈন্য সকলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর দরকার কি? এর থেকে নিঝঞ্ঝাটে রেজিষ্ট্রি বিয়ে অনেক স্বস্তির হবে।
সমর ঘোষাল খাওয়া থামিয়ে শুনল। আরো মুগ্ধ হল। মাথা নেড়ে আন্তরিক সায় দিল।খুব যুক্তির কথা, মা একটু খুঁত খুঁত করবে, কিন্তু কি আর করা যাবে! ঠিক আছে, রেজিষ্ট্রি বিয়েই হবে।
এবারে অতসীর সোজা-সরল প্রশ্ন, এ-তো হল, তারপর?
-তারপর কি?
বিয়ের পরের প্রোগ্রামটা কি?
–আই এ এস পরীক্ষায় ওপরের দিকে ঠাই পাওয়ার জন্য এবারে আরে আদা জল খেয়ে লাগব…মনে হয় ভালোই করব।
নিরুত্তাপ গলায় অতসী বলল, মনে হয় কেন, পরীক্ষা দিলে ভালো করবেই। …কিন্তু আমার দিকটা তাহলে ভাবছ না–
সমর ঘোষাল শশব্যস্ত, কেন কেন–তোমার কথা ভেবেই তো আমার আরো বেশি পছন্দ–কিন্তু তুমি কি ভাবার কথা বলছ?
অতসী মুখের দিকে চেয়ে টিপটিপ হাসছে।–তুমি আই এ এস অফিসার হয়ে জায়গায়-জায়গায় ঘুরে বেড়াবে আর আমি তাহলে সেই অতসী ফুলটি হয়েই কেবল তোমার ঘরের শোভা বাড়াবো?
এ দিকটা ভাবা হয়নি বটে, সমর ঘোষাল মনে মনে একটু হোঁচট খেয়ে উঠল। তারপর ব্যস্ত মুখেই বলল, তোমারও তো কোয়ালিফিকেশন কম নয়, তুমিও ভালো চাকরি পেয়ে যেতে পারো, আর গভর্নমেন্টের চাকরি হলে দুজনের এক-জায়গায় থাকতেও অসুবিধে হবে না।
মুখে হাসির আভাস লেগেই আছে। দুচামচ ফ্রায়েড-রাইস চালান দিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, পাঁচ বছর ধরে ছেলে-মেয়ে পড়াচ্ছি, এই এক চাকরি ছাড়া আমার আর কিছু ভালো লাগবে না। বি. এ এম. এ-র একটাতেও ফার্স্ট ক্লাস পেলাম না, গভর্নমেন্ট কলেজে চাকরি পাওয়ার কোনো আশা নেই, এ তুমি খুব ভালোই জানো। গভমেন্ট স্কুলে চাকরি পেতে পারি হয়তো, কিন্তু আই এ এস অফিসারের বউ স্কুল। মাস্টার এটা তোমার খুব ভালো লাগার কথা নয়, আর এখানকার প্রাইভেট কলেজের চাকরি যদি জোটেও তোমার বদলীর চাকরির সঙ্গে খাপ খাওয়ার কোনো আশাই নেই, তখন তুমি এক জায়গায় আমি এক জায়গায়। গা-ঝাড়া দিয়ে হেসে নিল একটু, মোটকথা তোমার ওই আই এ এস চাকরি আমার একটুও পছন্দ নয়।
বলার সুরটুকু এমনি সহজ অথচ স্পষ্ট যে সমস্যাটা সমর ঘোষালের কাছে। আন্তরিক হয়ে উঠল। একই সঙ্গে চিন্তার কারণও। বলল, তাহলে এ-রকম একটা বাজে কলেজেই পড়ে থাকব?
-তা কেন, আগাগোড়া ভালো কেরিয়ার তোমার, ইংরেজির মতো সাবজেক্ট একটাতে ফার্স্ট ক্লাস আর একটাতেও অদ্বিতীয় সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট, এই প্রভিন্সের এতগুলো য়ুনিভার্সিটির কোথাও না কোথাও অনায়াসে ঢুকে পড়তে পারো–পারো না?
সমর ঘোষাল সায় দিল, তা পারি।
উৎসাহে অতসীর মুখখানা আরো সুন্দর লাগছে।–টিচিং লাইনে এলে কত ছুটি ভেবে দেখেছ, আর কত সুবিধে? নিজেদের মধ্যে আমরা কত সময় পাক-ইচ্ছে করলে, তুমি ডক্টরেটের থিসিস সাবমিট করতে পারো, পয়সা করার ইচ্ছে থাকলে ছাত্রদের জন্য দরকারি বই লেখারও অঢেল সময় পেতে পারো–আই এ এসএর পিছনে ছুটে কেবল প্রতিপত্তি ছাড়া খুব বেশি আর কি পাবে?
কান জুড়নোর মতোই কথা আর যুক্তি। সোৎসাহে বলল, বেশ বেশ। আমি কোনো যুনিভার্সিটির চাকরিতেই ঢুকে গেছি ধরে নাও কিন্তু তখন তুমি কি করবে?
অতসীর হালছাড়া হাসি আর জবাব, তখন আমার আর কি সমস্যা! যেখানে তুমি, আমিও সেখানেই। কলেজের মোহ আমার নেই, স্কুলের চাকরি তো একটা জোটাতে পরিবই! প্রোফেসর হলে তখন আমার স্কুলের চাকরি নিয়ে কারোই কোনো কমপ্লেকস থাকবে না–দুজনের রোজগারে দিব্যি চলে যাবে–তার বেশি আমাদের। দরকার কি?
সমর ঘোষাল মুগ্ধ চোখে খানিক চেয়ে রইলো। তারপর আধাভরাট খাবারের ডিশ ফেলে কেবিনের পর্দা ঠেলে বেরিয়ে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে এলো। ফিরে এসে অতসীর গলা জড়িয়ে ধরে ফ্রায়েড রাইস আর চিলি-চিকেন খাওয়া মুখে গভীর একটা চুমু খেল।
অতসীর হাঁসফাস দশা। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, তুমি একটি অসভ্য!
সমর ঘোষাল বলল, তোমার থেকে আমি যত ভালো রেজাল্টই করি, প্র্যাকটিকাল বিচারবুদ্ধিতে আমি তোমার নখের যোগ্যও নই।
অতসর হাসিমুখ, সেই সঙ্গে ধমকের গলা, তাবলে ভক্তিশ্রদ্ধার ঠেলায় এরকম। হামলা! আরো সুযোগ সুবিধে থাকলে কি করতে?