.
এবারে অতসী নাম বাহারের প্রসঙ্গে বন্ধুদের কাছে সমর ঘোষালের সেই কটাক্ষপাতের প্রসঙ্গ–যা যুগপৎ আনন্দের সঙ্গে একটু তরল বিস্ময়েরও খোরাক যুগিয়েছিল। সমর ঘোষাল টিপ্পনির সুরে বলেছিল, নামের মধ্যে তোমরা কেবল নৈসর্গিক রসের বাস্তব রূপ দেখছো, কিন্তু ওই নামের সঙ্গে অদৃশ্য ছোট্ট একটু আকার যোগ করলে কি দাঁড়ায় তা কখনো ভেবেছ?
বলা-মাত্র কেউই বুঝে উঠল না। সমস্বরে প্রশ্ন, তার মানে?
–তার মানে অতসীর অ-এর সঙ্গে ছোট্ট একটু আ-কার জুড়ে দিলে কি দাঁড়ায়?
দুই একজনে তক্ষুণি বলেছে, কেন আতসী!
–ঠিক। তাহলে মানেটা কি দাঁড়ায়?
–ভেবে একজন বলেছে, আতসবাজি শুনেছি, আতসী সেই গোছের কিছু হবে।
-খুব ঠিক। আতসী মানে আগ্নেয়, যার জ্বলে ওঠার জন্য সামান্য একটু তাপই যথেষ্ট।…তা তোমাদের অতসীর সঙ্গে অদৃশ্য একটু আ-কার যুক্ত আছে কিনা ভেবে দেখেছ?
কথাটা স-পল্লবে অতসীর কানে উঠতে সময় লাগেনি। শোভনাই বলেছে। তারপর উৎসুক প্রশ্ন, কি রে, সমর ঘোষালের তোর মেজাজের আঁচ পাওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেছে নাকি?
না, অতসীর রাগ একটুও হয়নি, ভিতরে ভিতরে কেবল অবাক হয়েছে। অতসীর অ-এর সঙ্গে একটা আ-কার যুক্ত করলে কি হয়, তা কখনো ভাবেনি। কিন্তু যা হয় সেটা কত বড় সত্য তা ওই ছেলে কি বুঝে এমন টিপ্পনী কেটেছে, না নিছক ঠাট্টার ছলে? রাগ হলে বা আঘাত পেলে অতসীর ভিতরটা কি যে জ্বলে জ্বলে ওঠে, সব ভস্ম করে ফেলার মতো আক্রোশে ফুঁসতে থাকে সেটা ও নিজে ভিন্ন আর কে জানে? এমন হলে যন্না আরো বেশি, কারণ ভিতরে যতই জ্বলুক ফুসুক, বাইরে তার প্রকাশ কম। বাইরেটা সর্বদাই দাহ নিবারক শান্ত ব্যক্তিত্বে ঢাকা। ভিতরে বাইরে অতসী গাঙ্গুলী একজন নয়, প্রায় বিপরীত দুজন।
রাগের বদলে ওই একজনের প্রতি কৌতূহল দ্বিগুণ বেড়েছে। য়ুনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে দেখা হলে বা চোখাচোখি হলে মিটিমিটি হেসেছে। তারপর সেদিন এক ফাঁকে জিগ্যেস করেছে, সামনের রোববারে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে আসছ?
সমর ঘোষালও কদিন ধরে একটু যেন ব্যতিক্রম লক্ষ্য করছিল।-কেন বলো তো? ৩৪৮
-তোমাকে একটু কমপ্লিমেন্ট দেবার ছিল।
সত্যি অবাক।–কেন, কী করলাম?
কী করেছে মাথায়ও নেই বোঝা গেল। হেসেই জবাব দিল, তেমন কিছু না, দেখা হলে বলব।
লাইব্রেরিতে এসেছে। দুজনে দু জায়গায় বসে পড়াশুনা যেমন হয়–হয়েছে। তবে এইদিনে সমর ঘোষাল বেশ আগেই উঠে এসেছে। দেরি আছে?
অতসী নিজের হাতঘড়ি দেখল। এরই মধ্যে হয়ে গেল?
হয়ে গেল না, কমপ্লিমেন্ট পাওয়ার আশায় আর মন বসছিল না।
অতসীও হাসি মুখেই খাতাপত্র গুছিয়ে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে উঠে পড়ল। রাস্তায় নেমেই সমর ঘোষাল তাড়া দিল, কিসের কমপ্লিমেন্ট বলে ফেলো, সবুর সইছে না।
-তুমি খুব লোভী তো?
সমর ঘোষাল একবার থমকে তাকালো। তারপর হেসেই বলল, এমনিতে আমি খুব লোভী ছিলাম না, তবে মানুষের চরিত্র বদলাতে কতক্ষণ।…তা বলো, কমপ্লিমেন্ট কী কারণে?
অতসী কটাক্ষে একবার দেখে নিল। আগের মন্তব্য একেবারে তাৎপর্যশূন্য মনে। হল না। বলল, কমপ্লিমেন্ট অতসীর অ-এর সঙ্গে ছোট্ট একটা আ-কার জুড়লে কী দাঁড়ায় ছেলেদের সেটা বুঝিয়ে দেবার জন্যে।
শুনে সমর ঘোষাল প্রথমে জোরেই হেসে উঠল। ব্যাপারটা ভুলেই গেছল। হাসি থামাতে দুচোখ আবার পাশের দিকে ঘুরল। কমপ্লিমেন্ট তো দিলে…কিন্তু আসলে রেগে যাওনি তো?
–রেগে যাব কেন, তুমি তো অনেকটাই সত্যের কাছাকাছি গেছ…তবে আমার কেবল কৌতূহল, গেলে কি করে, নাকি এটা কেবল বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে নিছক রঙ্গরসের ব্যাপার?
সমর ঘোষাল মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।–সত্যি জবাব দিলে রেগে যাবে না তো?
-কেউ রেগে যাবে মনে হলেও তুমি সত্যের অপলাপ করো নাকি?
–তাহলে বলি।…তুমি আয়নায় নিজেকে দেখো?
–এ আবার কি কথা, রোজই তো দেখি!
বন্ধুদের যা বলেছি তার ষোল আনাই রঙ্গরসের কথা নয়, তার সঙ্গে তোমাকে নিয়ে আমার কিছু ধারণাও মেশানো ছিল।…তোমার চেহারাপ বা রুচির ছিমছাম বেশবাস চাল-চলন দেখলে কারো মনে হবে না দুদুটো টিউশানি আর নিজের হিম্মতের ওপর নির্ভর করে বি এ ইকনমিক্সে সেকেন্ড ক্লাস সেকেন্ড হয়ে এম. এ পড়তে এসেছ। বাসের আ-দেখলে চাপাচাপির ভয়ে তুমি সর্বদা ট্রামে যাতায়াত করো, সংগতি থাকলে ট্রামও এড়াতে। চরিত্রগতভাবে তুমি কেবল অতসী ফুলখানা হয়ে বসে থাকলে এত কষ্ট করে এভাবে এগোতে চেষ্টাই করতে না, অনেক আগেই যাচাই বাছাই করে কারো ঘরের শোভা বর্ধন করতে চলে যেতে। তাই আমার মনে হয়েছে যতই ওরা তোমার মধ্যে ফুলবাহার অতসীর মিষ্টি মিল টেনে বার করুক, দরকার হলে অতসী। থেকে তুমি আতসীও হয়ে উঠতে পারো।
অতসী কান পেতে শুনছিল। বলে উঠল, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ।
.
এরপর অনেক পাঠকের হয়তো প্রত্যাশা আর অনেক পাঠকের হতাশা, কাহিনা এবার চিরাচরিত প্রেমের রাস্তায় গড়াবে। …হা প্রেমের রাস্তায় এগনো একটু আছেই, তবে সকালের ঘাসের ডগায় মুক্তা-বিন্দুর মতোই স্বল্প পরমায়ু তার।
পড়াশুনার চাপ যথাসম্ভব বাড়িয়েও সমর ঘোষাল এম এতে ফার্স্ট ক্লাস পায়নি। কেউই পায়নি। সমর ঘোষাল সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে।
রেজাল্ট খুব প্রত্যাশিত হল না বলে অনেকে সহানুভূতি আর সান্ত্বনার কথা বলেছে। কেবল অতসী গাঙ্গুলী এ নিয়ে একটি কথাও বলল না বলে সমর ঘোষাল প্রথমে একটু অবাক হয়েছিল। পরে কিছু না বলাটাই তার ভালো লেগেছে-কথায় চিড়ে ভেজে না এই প্র্যাকটিকাল মেয়ে তা খুব ভালো করেই জানে।