ফেরার সময় দুটি ছেলে কলকাতায় ফিরবে বলে আমাদের জোঙ্গায় উঠেছে। সামনে ড্রাইভারের পাশে আমি আর বেয়াই। বেয়াইয়ের মুখ এখন থমথমে। চাপা রাগে বললেন, আমি আসছি জেনে এভাবে পালানোর জন্যেই তাকে স্যাক করব।
আমি নির্বাক। সামান্য মাথা নেড়ে সায় দিলাম। তাই করা উচিত। নিজের মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে নিয়ে এই কুৎসিত ব্যাপার সহ্য করব কি করে? ভয়ে পালিয়েছে সে-অপরাধ আমি অত বড় করে দেখছি না।
হঠাৎ সচকিত আমরা। পিছনের ছেলে দুটোর একজন বলে উঠল, ওই দুলালীর মা দাঁড়িয়ে।
মালিকের ইশারায় ড্রাইভার গাড়ির ব্রেক কষল। জংলা রাস্তার ধারে পঁচিশ ত্রিশ গজের মধ্যে বিবর্ণ খাটো শাড়ি-পরা এক রমণী দাঁড়িয়ে। হাড়ের ওপর কালো চামড়া মোড়া। চোখ দুটো গর্তে। চোয়ালের দুদিকের হাড় উঁচিয়ে আছে। রুক্ষ চুলগুলো তেলজলের মুখ দেখে না।
আমাদের দিকে, না ঠিক আমাদের দিকে নয়, সে মালিক চেনে মনে হল বেয়াইয়ের দিকে এমন চেয়ে আছে যেন চোখের আগুনেই তাকে ভস্ম করে ফেলবে। চোখ দুটো সত্যি জ্বলছে। এমন ক্রুদ্ধ হিংস্র ভয়ংকর মূর্তি জীবনে দেখেছি কিনা জানিনা। পারলে সে গাড়িটার ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। …
তবু, যে লোকের জন্য তার মেয়ের এতবড় সর্বনাশ হয়ে গেছে, সেই লোকের মনিবের ওপর এই রাগ অস্বাভাবিক মনে হল না।
সামনে এসে বেয়াই নামলেন। ভয়ে ভয়ে পিছনে আমিও। নিকষ কালো এই অগ্নিমূর্তির মেয়েলোকটা দিশেহারা রাগে ভদ্রলোকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
তার সামনে এসে ভারী অথচ সদয় গলায় বেয়াই জিগ্যেস করলেন, তুমি দুলালীর?
তক্ষুণি জবাব না দিয়ে মেয়েলোকটা জ্বলন্ত চোখে আমাদের দুজনকেই তার এক দফা ভস্ম করে নিল। তারপর হিসহিস গলায় তরল আগুনের ঝাঁপটা মাল। –ক্যানে, মোর পরিচয়ে তোমাদের কি দরকার বটটে?
ঠাণ্ডা গলায় বেয়াই বললেন, দরকার কিছু নেই।…আমরাও ওই ম্যানেজারের বির করতেই এসেছিলাম, কিন্তু দেখা পেলাম না, আপাতত পালিয়েছে। সঙ্গে তোমার মেয়েও। …ম্যানেজারের ব্যবস্থা হবে, কিন্তু তোমারও মেয়েকে একটু সামলে রাখা উচিত ছিল।
সঙ্গে সঙ্গে শুকনো বারুদে আগুন ধরানো সম্পূর্ণ হল। হাত, মুখ নেড়ে চারব না হয়ে ফেটে পড়ল।–তোমরা ওই মানিজারের বিচার করবেক, তাকে শাস্তি দিকে? ক্যানে তোমাদের এত হিংসা বটটে? ক্যানে শিকারীর মতো তোমরা ওই ভালো মানুষ মানিজারকে খুঁজতে লেগেছ? আমার মেয়েটা এট্ট ভালো খেতে পেলেক, পরার ভালো কখানি শাড়ি পেলেক, কানে হাতে পায়ে রূপার গয়না পেলেক-মুইও এটু সুখের মুখ দেখতে পালাম-তোমাদের তা সহ্যি হল না ক্যানে? তোমরা এততো নিষ্ঠুর ক্যানে? ক্যানে ক্যানে ক্যানে?
আমরা দুজনেই স্তব্ধ, নির্বাক, বিমূঢ়!
জোঙ্গা ছুটেছে। আমরা আবার পাশাপাশি বসে। অনেকক্ষণ বাদে বেয়াই খ খুললেন। তার ঠোঁটে হাসির আঁচড়। ভারী গলা যতটা সম্ভব মৃদু করে বললেন, কে কাকে ফাঁদে ফেলেছে মশাই?…এরপর বিচারটা কি-রকম হবে?
বিড়বিড় করে জবাব দিলাম, জানি না।
জোঙ্গা ছুটেছে। আমার চোখের সামনে হাসির মুখ, তার মেয়ে সুমিতার মুখ, তার ভাই দুটোর মুখ ভাসছে। রাস্তার দুদিকে আর কাছে-দূরে শাল পিয়াশাল জিয়াল পলাশ মহুয়া বহেরার গাছ। সামনে তকতকে নীল আকাশ। সব কিছু ছাপিয়ে চোখের সামনে বড় হয়ে উঠছে নিকষ কালো এক রমণীর ক্রুদ্ধ ক্ষিপ্ত জ্বলন্ত ক্ষুধার্ত মুখ।