আমার মেয়েকে নিয়ে ভদ্রমহিলা বেরিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে দরজা দুটো টেনে। দিলেন। আমি উৎসুক একটু, কি ব্যাপার?
–এমন কিছু নয়, ভদ্রলোকের হাসি মুখ, আগে শুরু তো করুন–
প্রথম দফায় ওই ড্রিংক আর ফুড নিয়েই হালকা কথা-বার্তা। দ্বিতীয় দফার শুরুতে হাসিমুখেই ভদ্রলোক জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে সবিনয় দত্তর চাকরিটা যে গেছল সে-কি কোনো মেয়ে-টেয়ের সঙ্গে কিছু অ্যাফেয়ারের ব্যাপারে?
আমি এত চমকে উঠলাম যে হাতের গেলাস থেকে খানিকটা ড্রিংক চলকে জামায় পড়ল। ভদ্রলোক অপ্রস্তুত একটু, পাশ থেকে ছোট তোয়ালেটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, কি কাণ্ড, এ-রকম ধাক্কা খাবার মতো কিছু ব্যাপার নয়–
ভদ্রলোকের স্নায়ু আমার থেকে দশগুণ শক্ত এ অনেক দিন জানি। তাই আশ্বস্ত হওয়া গেল না। জামাটা মুছে সোজা তাকালাম, বললাম, চাকরি ওই রকম কিছু ব্যাপারেই গেছল শুনেছি…কি হয়েছে আমাকে খোলাখুলি বলুন।
-বলছি। খান…।
খাওয়া মাথায় উঠেছে। কিন্তু ভদ্রলোকের কাছে ব্যস্ততা দেখিয়ে লাভ নেই। এরপর খেতে খেতে ধীরে সুস্থে যে সমাচার শোনালেন, ভিতরে ভিতরে আমি নিস্পন্দ কাঠ।
….মেজিয়ার একটা নিচু শ্রেণীর মেয়েকে নিয়েই ব্যাপার এবারও। বছর উনিশ হবে বয়েস। যারা দেখেছে তারা বলে খুব কালো হলেও ওদের মধ্যে অন্তত চোখে পড়ার মতো মেয়ে। ওদের শ্রেণীর একটা ছেলের সঙ্গে বিয়েও নাকি ঠিক হয়ে আছে, কিন্তু মেয়ের মা মোটা রকম পণ হাঁকতে ছেলেটা দেড় বছর ধরে টাকা জমানোর চেষ্টায় আছে। এর মধ্যে ওই মেয়েটাকে সুবিনয় টাকা গয়নার টোপ ফেলে বশ করেছে। ব্যাপারটা এখন ক্রমেই ঘোরালো হয়ে উঠছে। তিন-চার মাস যাবৎ বেয়াই এ নিয়ে কিছু কানা-ঘুষা শুনছেন। কিন্তু যে লোক অত ভাল কাজ করে তার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে তিনি মাথা ঘামানো দরকার মনে করেন নি। এখন না ঘামিয়ে পারছেন না। ম্যানেজার সুবিনয় দত্তর নামে কয়েকটা বে-নামী চিঠি পেয়েছেন–তার ধারণা, ওর আন্ডারের যে-সব লোক সাহস করে মুখে কিছু বলতে পারছে না, হিংসেয় হোক বা রাগে হোক তাদেরই কেউ কেউ এ-সব চিঠি পাঠাচ্ছে। বেয়াই তাতেও গা করতেন না, কিন্তু এখন লেবারের মধ্যেও এ নিয়ে অশান্তি দেখা দিচ্ছে, যে-ছেলেটার সঙ্গে মেয়েটার বিয়ে হবার কথা সেই এখন লেবারদের ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টায় আছে। ভালো করে খোঁজ-খবর নেবার জন্য বেয়াই এ-সপ্তাহে একজন বয়স্ক ইনসপেক্টরকে পাঠিয়েছিলেন। সে-ও এসে দুশ্চিন্তার কথাই বলেছে। মেয়েটার নাম দুলালী। সুবিনয় এখন নিজের বাড়িতেই এনে রেখেছে। খাবার সময় সাইটের ক্যানটিনে সে এখন-খেতে পর্যন্ত আসে না। ক্যানটিন থেকে ওদের দুজনের খাবার তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতে হয়। এ-সব এখন অনেকেই বরদাস্ত করতে পারছে না। বক্তব্য শেষ করে ঈষৎ আশ্বাসের সুরে বেয়াই বললেন, সামনের শনিবারে কাউকে কিছু না জানিয়ে ওই ইনসপেক্টরকে নিয়ে আমি নিজে যাব, লেবার ক্লাসের মধ্যে গণ্ডগোলের সম্ভাবনা দেখলে আমাকে স্টেপ নিতেই হবে…তা না হলে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই-আমার ইচ্ছে শনিবার আপনিও আমার সঙ্গে চলুন।
মাথায় আগুন জ্বলছে। ব্লাড প্রেসারও চড়ে গেছে বোধহয়। বললাম, আমার যাবার দরকার নেই, আপনি সিভিয়ার স্টেপ নিন।
ওঠার আগে ভদ্রলোক বার বার বললেন, আপনার আজকের আনন্দটাই মাটি করে দিলাম দেখছি।
বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে একটি কথাও বললাম না। ভেতরে অশান্তির ঝড়। আবার মেয়ে আর ছেলে দুটোর শুকনো মুখ চোখে ভাসছে। হাসির কালো মুখ চোখে ভাসছে। এমন অশান্তিতে জীবনে কখনো পড়িনি। রাতে ঘুম হলই না। হাসি আর ওর মেয়ে আর ছেলে দুটোর কথা ভেবে আমার মনের জোর কমে গেছে। সকালে উঠে ফোনে বেয়াইকে জানালাম, শনিবারে আমি তার সঙ্গে মেজিয়ায় যাচ্ছি।
মনের তলায় ক্ষীণ আশা, ওই সুবিনয়কে শায়েস্তা করার জন্য পায়ের থেকে জুতো খুলে মেরেও যদি ওর চাকরিটা বজায় রাখার সুযোগ মেলে তো তাই করব –তবু চাই না এতবড় অশান্তির খবর হাসি বা তার সংসারের কেউ জানুক।
গরম কাল। সকাল ছটায় রওনা হয়ে সাড়ে বারোটায় বেয়াইয়ের সঙ্গে তার জোঙ্গায় চেপে মেজিয়ায় পৌঁছেছি। সঙ্গে সেই বয়স্ক ইনসপেক্টর আর আরো একজন। লোক। খুব সকালে বেরুনোর ফলে এরই মধ্যে দুর্গাপুরে সকলে দুপুরের খাওয়াও সেরে নিতে পেরেছি।
মেজিয়ায় পৌঁছে আর সাইটে এসে বেয়াইকেও হতভম্ব দেখলাম একটু। সেখানে সুবিনয় নেই। ভয়ে ভয়ে একজন কর্মচারী জানালো, সে তার বাড়িতেও নেই, সকাল। থেকেই বাড়ি তালা-বন্ধ। আরো খোঁজ নিতে জানা গেল গত রাতে পর্যন্ত সেই মেয়েটা অর্থাৎ দুলালও তার বাড়িতে ছিল। সকালের মধ্যে দুজনেই কোথায় উধাও হয়ে গেছে।
মেজিয়া থেকে হামেশাই কেউ না কেউ কলকাতার অফিসে যাতায়ত করে। গত কদিনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সাহেব আজ আসছে আর কি জন্যে আসছে সে খবর সুবিনয় কোনোভাবে জেনেছে সেটা স্পষ্টই বোঝা গেল। তাই মেয়েটাকে সুষ্ঠু নিয়ে কোথাও গা-ঢাকা দিয়েছে।
ঘণ্টা তিনেক থেকেও সেখানকার লেবার ক্লাসকে ম্যানেজারের ওপর ক্ষুব্ধ মনে। হল না আমাদের। যার সঙ্গে দুলালীর বিয়ে হবার কথা সে এখানকার শ্রমিকদের কেউ নয়, কাজেই তার দেখা পাইনি। কিন্তু এখানকার শ্রমিকদের সে ক্ষেপিয়ে তুলছে এমন আভাসও পেলাম না। ম্যানেজারের ওপর ভদ্রলোক কর্মচারীরাই কেবল বিরূপ। ব্যাপারটা সম্ভবত তারাই বরদাস্ত করতে রাজি নয়। সাহস পেয়ে তারা অনেকেই বলেছে ম্যানেজার। সুবিনয় দত্তকে এখান থেকে না সরালে তাদের মান থাকে না।