আমার বেয়াই আর জামাইয়ের মস্ত কন্ট্রাকটারি ফার্ম। কনস্ট্রাকশন আর ডেভেলপমেন্ট দুরকম কাজেই তাদের বহু লোক খাটছে। কিন্তু সেখানে কারো কাজের সুপারিশ এ-পর্যন্ত করিনি। তবু আমিও যেন একটা পথ দেখতে পেলাম। কারণ। বেয়াইয়ের সঙ্গে আত্মীয়তার থেকেও হৃদ্যতার দিকটা ঢের বড়। ভদ্রলোক বাইরে মেজাজী রাশভারী মানুষ, কিন্তু ভিতরে যেমন উদার তেমনি দিলদরিয়া।
পরে জানাবো বলে হাসিকে তখনকার মতো যেতে বললাম। বেয়াই বেশি শুনতে চাইলেন না। আমি অনুরোধ করছি সেটাই যথেষ্ট ধরে নিয়ে সুবিনয় দত্তকে তার কাছে। পাঠিয়ে দিতে বললেন।
চাকরি হল। রিহ্যাবিলিটেশনে কাজ করেছে জেনে ছেলের অর্থাৎ আমার জামাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে ডেভেলপমেন্টের কাজে দিলেন। মাইনে সর্বসাকুল্যে ছশ। দিন-কাল যা ছশ টাকা কিছুই না। কিন্তু হাসি তাতেই হাতে স্বর্গ পেল। আমি বললাম, মন দিয়ে কাজ করতে বল, এরা গুণের কদর করতে জানে।
হাসি হেসে জবাব দিল, সেটা আমি তাকে খুব ভালো করে সমঝে দিয়েছি–অনেক বার বলেছি, বেয়াইয়ের কাছে কক্ষনো তোমার জন্যে মামাবাবুর মুখ ছোট হলে রক্ষে থাকবে না।
এত দিন বাদে ওকে ওইটুকু হাসতে দেখেও মনে হল, সময়ে ও আবারও আগের। মতোই হাসতে পারবে। মুখেও বললাম, আমার মুখ নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না, আমি কেবল তোর মুখে হাসি দেখতে চাই।
ছলছল চোখে হাসি পায়ের ধুলো নিল। বলল, আশীর্বাদ করো মামাবাবু, তোমার দেওয়া নাম আর যেন কালো না হয়।
হয়নি। ছমাস না যেতে বেয়াইয়ের মুখে সুবিনয়ের প্রশংসা। খাসা লোক দিয়েছেন মশাই, চেহারা দেখলে বোঝা যায় না এত খাটতে পারে, তাছাড়া সারভের কাজে বেশ পাকা, ডেভেলপমেন্টের কাজেও ভালো মাথা–কেউ শত্রুতা না করলে এ-রকম লোকের চাকরি যায় কি করে।
চাকরি কি করে যায় সে-আলোচনায় আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। বেয়াই যে খবরটা নিজে আমাকে বলেননি, হাসিমুখে এসে সে-খবর আমাকে হাসি দিল। এই ছমাস যেতেই সুবিনয়ের মাইনে আরো একশ টাকা বেড়েছে–আর পাকা খাতায় তার নাম উঠেছে, অর্থাৎ এরপর চাকরির শেষে প্রভিডেন্ট ফান্ড গ্র্যাচুইটিও পাবে।
.
পরের তিন বছরের সমাচারে নিরানন্দের ছিটে ফোঁটাও নেই। হাসির বয়েস এখন ছত্তিরিশ, তার মেয়ে সুমিতার আঠারো। মেয়ের চেহারা মোটামুটি। এ-বয়সে তার মা যা ছিল তার ধারে কাছেও নয়। এবারে হায়ার সেকেনডারি দেবে। মেয়ের বিয়ের ভাবনা-টাবনা হাসির মাথায় নেই। অনেক দিনই বলেছে, লেখাপড়ায় ভালোই, যতটা পড়তে চায় পড়ুক, তারপর বিয়ে। আঠারো বছরের মেয়ের মুখের হাসির থেকে এখনো ছত্তিরিশ বছরের মায়ের হাসি আমার চোখে ঢের বেশি সুন্দর।
বছরখানেক হল সুবিনয়কে বাঁকুড়ায় থাকতে হচ্ছে। বাঁকুড়ার অনেকটা ভিতরে মেজিয়া। সেখানে থারমল পাওয়ার স্টেশন হবে। সেইজন্যে আশপাশের বিরাট এলাকা। জুড়ে মাটি কাটা আর জমি ভরাটের কাজ চলছে। এসব জায়গায় নতুন টাউনশিপ গড়ে উঠবে। এই মাটি কাটা আর জমি ভরাটের বিশাল কন্ট্রাক্ট আমার বেয়াই পেয়েছেন। এই তিন বছরের মধ্যেই নিজের যোগ্যতায় সুবিনয় আরো অনেক ওপরে উঠেছে। Tই গত বছর তাকেই ম্যানেজার অর্থাৎ এ-কাজের সর্বেসর্বা করে পাঠিয়েছেন। এখন তার মাইনে বারো শ টাকার ওপরে। দুশর মতো কুলি-মজুর কামিন খাটায়, তার অধীনে দুজন সহকারী ম্যানেজার, জনা দুই সারভেয়ার, জনাকতক সুপারভাইজার আর ট্রাক, ড্রাইভিং ইউনিট কাজ করছে। এরা সকলেই সাইট-এর টেন্ট-এ থাকে। সুবিনয় গ্রামের ধারে ছোট একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। তার এখন আলাদা মর্যাদা। তবে সক্কলেরই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা টেন্ট ক্যানটিনে। আমার বেয়াই ভদ্রলোক নিজে ভোজন-রসিক, কর্মচারীদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও তার ফার্মের উদার নীতি। বেশ বড় আকারের এক ক্যানটিন ইউনিটও সেখানে বহাল।
কলকাতা থেকে মেজিয়া মোটরে বা জীপে সাত ঘণ্টার মতো পথ। বেয়াই তার নিজস্ব জোঙ্গায় (জীপের মতোই, আকারে বড়) মাসে দুই একবার সেখানে ইনসপেকশনে যান। আর ছেলে অর্থাৎ আমার জামাই এখানে ফার্মের অন্য কাজে ব্যস্ত, তাই ফি সপ্তাহে দেখে শুনে আসার জন্য অন্য ইনসপেক্টর আর এঞ্জিনিয়ার পাঠাতে হয়। সুবিনয় দুতিন মাসে দুই একদিনের জন্য কলকাতায় আসে, কাজের চাপে তার বেশি আসা সম্ভবও নয়।
তকতকে নীল আকাশ থেকে বজ্রপাত কি সত্যি কখনো হয়? সেদিন বিকেলে বেয়াইয়ের টেলিফোন পেয়ে অন্তত আমার মনে কোনরকম আশংকার ছায়াও পড়েনি। চিরাচরিত হাসি-ছোঁয়া ভারী গলা। বললেন, অনেক দিন বসা হয়নি, সন্ধ্যার দিকে একবার আসুন না, একটা ভালো জিনিস খুলব…তাছাড়া একটু আলোচনাও আছে।
এ-রকম আমন্ত্রণ নতুন কিছু নয়। ভালো জিনিসের লোভ দেখানোর অর্থ বিলিতি বোতল। আনুষঙ্গিক খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও ভালোই থাকে। ভদ্রলোকের বড় কোনো কাজের ধকল শেষ হলে এই গোছের আমন্ত্রণ আসে। এ-বয়সেও ওই এক জিনিসে আমারও একটু-আধটু লোভ আছেই।
খুশি মনেই গেলাম। তখনও ভদ্রলোকের হাসিমুখে এতটুকু দুর্যোগের আভাস পাইনি। সকলে মিলে খানিক গল্পগুজব চলল। বৈবাহিকা আর মেয়ে খাবার আর অন্যান্য সরঞ্জাম সাজিয়ে দেবার পর ভদ্রলোক বললেন, এখন আমাদের একটু দরকারি আলোচনা, আছে