হাসির মুখে হাসি নেই এ আমার কাছে শুধু বিস্ময় নয়, আঘাতের মতোও। এরপর কদিন লক্ষ্য করেও ওকে দেখতে পাইনি। ওদের এ-বাড়িমুখো দোতলার ঘরের জানালা দুটো এখন প্রায় সময়ই বন্ধ থাকে। সুবিনয়কেও সত্যি কদিন একতলার দাওয়ায় বসে থাকতে দেখেছি। বিষণ্ণ, বিমর্ষ মুখ। ফর্সা মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। দেখলেই মনে হয় সুখের শরীর-মনের ওপর দিয়ে কিছু একটা ঝড় গেছে।
রাস্তায় হঠাৎ সেদিন মুখোমুখি দেখা। মাথা নিচু করে সুবিনয়ের পাশ কাটানোর চেষ্টা। কিন্তু হাসির জন্যে আমার মনেও কম অশান্তি নয়। ওকে পাশ কাটাতে দিলাম না। জিগ্যেস করলাম, অনেকদিন হাসির দেখা নেই, ভালো আছো তো সব?
সুবিনয় মিনমিন করে জবাব দিল, আজ্ঞে হ্যাঁ..ভালোই।
–তুমি অফিসে যাচ্ছ না দেখছি..ছুটিতে আছ নাকি?
–হ্যা…অনেক ছুটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে…
আর কথার ফুরসত না দিয়ে যেন পালিয়ে বাঁচল। বড় রকমের কিছু গণ্ডগোল বেধেছে তাতে কোনো ভুল নেই। কিন্তু সেটা পারিবারিক ব্যাপার না আর কিছু!
মাস দেড়েক বাদে আবার আমার স্ত্রীর মুখেই সমাচার শুনলাম। এর মধ্যে সে আরও অনেকবার জানলা-দরজা বন্ধ ওই মুখোমুখি ঘর থেকে হাসির তর্জন-গর্জন। শুনেছে। সদ্য বর্তমানে হাসিদের একতলার পুরনো ভাড়াটে-গিন্নি ওদের ওপর দারুণ। বিরূপ। হাসি নাকি এতকালের হৃদ্যতা ভূলে ভাড়া ডবল বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে গেছে। ভাড়াটে-গিন্নি আমার স্ত্রীর কাছে এসে নালিশ করেছে, মগের মুলুক ভেবেছে এটা–ভাড়া ডবল বাড়াতে চাইলেই হল–আর যা ব্যাপার এখন, ভাড়া ডবল বাড়ালেই অভাব মিটবে-চরিত্র-দোষে জামাই অমন চাকরিখানা খুইয়ে বসেছে, এখন ভাড়াটের ওপর চড়াও হলে কত আর সুরাহা হবে!
.
এরপর ওদের ভাড়াটে-গিন্নির কথা থেকে বোঝা গেল, পাড়ার মধ্যে আমরাই কেবল প্রতিবেশীর খবর রাখি না, নইলে কেলেঙ্কারির খবর কে আর না জানে! যে টুকু বোঝা গেল তার সারমর্ম, পুনর্বাসন দপ্তরের চাকরি সুবিনয় দত্তর, গরিব ঘরের কত উদ্বাস্তু পরিবারের হর্তাকর্তা বিধাতা ভাবত নিজেকে, কিন্তু ঘুঘু আর কতবার ধান খেয়ে যাবে–একবার ফাঁদে পড়বে না? এক বিধবা মেয়ের সর্বনাশ বলতে গেলে হাতে-নাতে প্রমাণ হয়ে গেছে, শুধু চাকরির ওপর দিয়ে সব নিষ্পত্তি, জেল হয়ে যায়নি এই রক্ষে। সোয়ামির সঙ্গে মেয়ের দিন-রাত কুরুক্ষেত্র চলেছে এখন, মেয়ের গলার চোটে এক-তলায় কান-পাতা দায়, দুবেলা হিসহিস করে স্বামীকে শাসাচ্ছে, অমন লম্পটের জেলে পচে মরাই উচিত ছিল, তাহলে তার হাড়ে বাতাস লাগত। মেয়েও বলিহারি! দুবেলা মাথা খোঁড়ে আর বিধবা হতে চায়! বাইরে এ-দিকে ঢাক ঢাক গুড়গুড়–কিন্তু সত্যি কথা কদিন আর জানতে বাকি থাকে!
বুঝলাম, পাড়ায় এই সত্যি-কথা রাষ্ট্র করার গুরু দায়িত্ব ওদের ভাড়াটে-গিন্নিই। নিয়েছে।
আমার হাড়-পাঁজরে একটা বোবা যন্না ছড়িয়ে পড়ছিল। মেয়েটাকে আমি কত ভালবাসি তা যেন এতদিন জানতাম না। কেবল আশা করছি, বিনা দোষেও তো। অনেকে অনেক সময় বিপাকে পড়ে–এ কি সেরকম কিছু হতে পারে না? রাগে দুঃখে মাথার ঠিক নেই বলেই হাসি হয়তো সহ্য করতে পারে না। কিন্তু সুবিনয়ের সর্বদা অপরাধী মুখ দেখে এ আশাও ফিকে হয়ে আসছিল।
পরের একটা বছরে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। হাসির মুখে হাসি তো নেই-ই। ওদের সংসারে অনটনের ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শুনেছি, সুবিনয়ের চাকরিই শুধু যায়নি, হাতে শুধু নিজের-দেওয়া প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা কটাই পেয়েছে। এ ছাড়া সতের বছরের চাকরির পেনশন গ্র্যাচুইটি সবই মার গেছে। মেয়ে আর ছেলে। দুটো নামকরা স্কুলে পড়ত, স্কুল বাসে যাতায়াত করত। ক্লাস-প্রমোশন হয়ে যেতে তারা কাছাকাছির এমন স্কুলে ভর্তি হয়েছে যেখানে স্বল্পবিত্তের মানুষও পারতে ছেলে মেয়ে দিতে চায় না। ওই ছেলে-মেয়ের মুখের হাসিতেও টান ধরেছে। হাসিকে থলে হাতে ইদানীং ক্বচিৎ কখনো কাছের বাজারে যেতে বা আসতে দেখি। কিন্তু এ-বাড়ির দোতলার দিকে ছেড়ে মুখ তুলে কোনদিকেই ওকে তাকাতে দেখি না। শুকনো টান ধরা মুখ। পুজো এলো গেল, কিন্তু এবারে ও বিজয়ার প্রণাম করতেও এলো না। ডাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সংকোচ হয়, ডাকতে পারি না। আমার স্ত্রীও দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে, অত হাসি-খুশি মেয়েটা কি হয়ে গেল!
এক বছর বাদে। সকালে অন্যদিনের মতোই কাজে বসেছিলাম। মুখ তুলে আমিই সচকিত হঠাৎ। হাসি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে।
ভিতরে আসব মামাবাবু?
আমিও গম্ভীর একটু।–আয়। কবে আবার জিগ্যেস করে এ-ঘরে ঢুকেছিস? বোস–
হাসতে চেষ্টা করল। এ হাসি কান্নার মতোই। একটা মোড়া টেনে বসল। বলল, মুখ কেন দেখাতে পারি না জানোই তো…
আমি কিছুই জানি না, জানতে চেষ্টাও করি না। বিনা দোষেও অনেকের ওপরে অনেক অবিচার হয়। কিন্তু যত দুঃখের ব্যাপারই হোক, তুই আমাকে সুষ্ঠু হেঁটে দিলি?
চুপচাপ চেয়ে রইল একটু।–আমার সব গুমর ভেঙে গেছে মামাবাবু, দিন আর চলছেই না, তাই না এসে পারলাম না….যা হোক কিছু ব্যবস্থা করতে পারো?
হাসির মতো মেয়ের হার-না-মানা মুখের থেকে হার-মানা মুখ দেখলে বেশি কষ্ট হয়। আমি কি করতে পারি না বুঝে জিগ্যেস করলাম, কি ব্যবস্থার কথা। বলছিস?
দেখলাম, সহানুভূতি সত্ত্বেও আমার মাথায় যা আসেনি, বিপাকে পড়ে হাসি তা ভাবতে পেরেছে। মাথা নীচু করে সাদা কথায় বলল, আমার বেয়াই বা জামাইকে বলে যদি সুবিনয়ের কোনো কাজের ব্যবস্থা করতে পারি। একবার মুখ তুলে আমার প্রতিক্রিয়া দেখে আবার মাথা নীচু করল-লোকটা যেমনই হোক, কাজে-কর্মে খুব সুনাম ছিল মামাবাবু…।