–আমার এখন বিয়েই পছন্দ নয়, হায়ার সেকেণ্ডারি পাস করলাম না, এরই মধ্যে বিয়ে! তারপরেই দস্তুরমতো মিনতি, তুমি মা-কে ডেকে একটু বলো মামাবাবু, তোমার কথা শুনতে পারে–
বিড়ম্বনায় পড়ে জবাব দিলাম, ভালো ছেলে পেলে সব বাবা-মা-ই মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফেলতে চায়, চোখ-কান বুজে আপাতত বিয়েটা করে ফ্যাল, আমি বরং তোর বরকে শাসিয়ে দেব, এরপর না পড়ালে বিয়ে নাকচ হয়ে যাবে।
ঠোঁট উল্টে হাসি বলল, আর ছাই পড়া হবে, দেখো–
আষাঢ়েই বিয়ে হয়ে গেল। বর দেখে আমারও যে খুব একটা পছন্দ হয়েছে। তা নয়। ফর্সা, বেঁটে, মোটাসোটা, নাকের নিচে এক ইঞ্চির মতো এক খাবলা গোঁফ। কিন্তু সাধারণ ঘরের বিয়ের বাজারে ছেলের বিদ্যে আর ভালো চাকরিরই কদর। মেয়ে সুখে থাকলে একেই সকলে সোনার ছেলে বলবে।
শ্বশুর বাড়ি যাবার আগে হাসি প্রণাম করতে এলো। সেই প্রথম বোধ করি ওর কাঁদ কাদ মুখ দেখলাম ছদ্ম বকুনির সুরে বললাম, হাসির মুখে কান্না দেখলে। আমার দেওয়া নামের অপবাদ হবে বলে দিলাম! ফিক করে একবার হাস দেখি?
এ-কথার পর হাসিমুখেই প্রণাম করে গেছে।
.
হিসেব না রাখলে সময় পাখা মেলে ওড়ে। দশটা বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে হাসি কত শত বার বাপের বাড়ি শ্বশুর বাড়ি করেছে তা খেয়াল করার মতো কখনো কিছু ঘটেনি। এই সাতাশ বছর বয়সে হাসি রীতিমতো গিন্নি-বান্নি গোছের হয়ে উঠেছে। এখন এক মেয়ে আর দুই ছেলের মা। মেয়ে বড়ো। ছেলে দুটো ছোট। পড়াশুনা আর হয়নি। বিয়ের এক বছর না ঘুরতে মেয়ের মা হয়ে বসেছে, পড়াশুনা হবে কি করে! এই দশ বছরে খানিকটা মুটিয়েছে, কিন্তু লম্বা বলে খারাপ দেখায় না, উল্টে আরো ফর্সা আর ঢলঢলে মনে হয়। পান খায় খুব, মুখে সেই হাসি লেগেই আছে। দেখা হলেই লাল দুই ঠোঁটের হাসি সমস্ত মুখে ছড়ায়। আমি বলি, পান খাস কেন, অত সুন্দর দাঁতগুলো বিচ্ছিরি হয়ে যাবে।
ও হেসেই বলে, গেলেই হল, কত বার করে দাঁত মাজি জানো!
দাঁতের যত্ন নেয় বোঝা যায়, হাসলে পানের লাল রসে ভেজা দাঁতে সাদার চেকনাই ঝিকঝিক করে। হাসির মুখের হাসি আগের মতোই সুন্দর।
এই দশ বছরের মাথায় একটা অঘটন ঘটে গেল! তৃতীয় বারের হার্ট অ্যাটাকে হাসির বাবা নয়ন মারা গেল। তার পর থেকেই হাসি মেয়ে আর ছেলে দুটোকে নিয়ে বাপের বাড়িতে মায়ের কাছেই থাকে। বড় মেয়ে আর বড় ছেলেটা এ-দিকের স্কুলেই ভর্তি হয়েছে। হাসির মুখেই শুনেছি ছেলে-মেয়ে নিয়ে মায়ের কাছেই থাকবে। ভাসুরদের সঙ্গে এই ব্যবস্থা করে এসেছে। ওর বরের নাম সুবিনয় দত্ত। দশ বছরে ওর চেহারা আরো পরিপুষ্ট আর ভারিক্কি গোছের হয়েছে। তাকে এখন সপ্তাহে দুতিন দিন অন্তত এই শ্বশুর বাড়ির রাস্তায় দেখা যায়। শুনেছি রিহ্যাবিলিটেশনের কাজে প্রায়ই এখন তাকে কলকাতার বাইরে থাকতে হয়। ছেলে-মেয়ে নিয়ে হাসির মায়ের কাছে এসে থাকার এ-ও একটা কারণ। তাছাড়া ও না থাকলে এখন আর মাকে কে দেখবে।
আরো তিন বছর বাদে দ্বিতীয় অঘটন। হাসির মা মনোরমা লিভার ক্যানসারে মারা গেল। বাবার চিকিৎসা বা সেবা হাসি করতে পারেনি। কিন্তু মায়ের জন্য যথাসাধ্য করেছে। বাপের বাড়ির বোল আনার মালিক হবার জন্য মাকে এতটুকু তুচ্ছ করেছে, এ ওর শত্রুও বলতে পারবে না। যদিও বর সুবিনয় এ বাড়ির পাকা বাসিন্দা হবার পর অনেকের চোখ টাটিয়েছে। আড়ালে কেউ কেউ বলেছে, লোকটার ভাগ্য বটে, বিয়ের দৌলতে কলকাতার মতো জায়গায় আস্ত একখানা বাড়ির মালিক হয়ে বসল।
কলকাতায় থাকলে সুবিনয় এখন এ-বাড়িতেই থাকে, এখান থেকে অফিস যাতায়াত করে। তবে দফায় দফায় মাসের প্রায় অর্ধেক দিন বাইরে কাটাতে হয়। হাসির মতো গিন্নি মেয়ের খুব বেশি দিন শোক আঁকড়ে বসে থাকার কথা নয়। সময়ে। আবারও তার পান-খাওয়া ঢলঢলে মুখে সেই পুরনো হাসির ছোঁয়া লাগল। ঘরের বা ছেলেমেয়ের ব্যাপারে কোনো পরামর্শের দরকার হলে সোজা আমার ঘরে চলে আসে। তেমনি হেসে বলে, এলাম আবার জ্বালাতে, রামর্শের দরকার হলে এখন আর তুমি ছাড়া কার কাছেই বা আসব
আমি বলি, কেন সুবিনয় টুরে নাকি?
হাসি ঠোঁট উল্টে দেয়, থাকলেই বা কি না থাকলেই বা কি, ভালো-মন্দ কোনো কিছুর মধ্যে আছে–বিয়ের সময় যা ছিল তার থেকে আরো ভোদকা হয়ে গেছে দেখো না!
সেই রকমই চোখ-জুড়ানো হাসি।
ওর এখন বছর বত্রিশ বয়েস। আর ছেলেপুলে হয়নি। সেজন্য মনে মনে ওরই বুদ্ধি আর বিবেচনার প্রশংসা করি। অনেক দিন আগে এই ছেলেপুলের প্রসঙ্গে ওর মামী অর্থাৎ আমার স্ত্রীকে নাকি বলেছিল, তোমাদের জামাইয়ের স্বভাব চরিত্র যা –ছবছরের মধ্যে তিন-তিনটে চলে আসতে ওই ভালো-মুখো লোককে আর বিশ্বাস। করি! ছোটটা আসার পরেই অপারেশন করিয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত।
হাসি হেসে-হেসেই এ-রকম কথা বলতে পারে বটে।
এই হাসির মুখ হঠাৎ থমথমে হয়ে ওঠা থেকেই এই কাহিনী। কিছুদিন ব্যস্ত ছিলাম, তাই লক্ষ্য করিনি। হাসি অনেক দিন আসেনি তা-ও খেয়াল করিনি। সেদিন স্ত্রীর কথায় টনক নড়ল। সে বলল, মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে বোধহয়, আসে না, হাসে না, কথা-বার্তাও বলে না–
আমি অবাক।–কার কথা বলছ?
–হাসির। সুবিনয়ের সঙ্গে কিছু একটা হয়েছে, তিন সপ্তাহ হল ওকেও বাড়িতে বসা দেখছি, অফিস-টফিসেও যেতে দেখি না, মুখ চুন করে বাড়ির সামনের দাওয়ায় বসে থাকে–আর এক-একদিন দেখি মেয়েটা আগুনপানা মুখে ফটাফট করে আমাদের দিকের ঘরের জানলা-দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে, তা-সত্ত্বেও ও-ঘর থেকে ওর গর্জন আর বকাবকি কানে আসে–ডেকে কিছু জিগ্যেস করতে পারি না–এরকম হাসি খুশি মেয়েটার হঠাৎ কি হলো বলো তো?