সময় সময় আমারও গম্ভীর থাকার চেষ্টা।-জ্বর জ্বরই লাগছে, দ্যাখ তো–
তক্ষুণি কাছে এসে কপালে হাত, বুকে হাত। তার পরেই ঠোঁট উল্টে হাসি। –ধেৎ, পাথরের মতো ঠাণ্ডা গা–তাছাড়া জ্বর জ্বর মনে হলে কেউ পাখার নিচে খালি গায়ে বসে লেখে? আমাকে ঠকাবার মতলব?
–আর তোর পাকামো করতে আসার মতলব?
তক্ষুণি হি-হি হাসি আর ছুট। ভিতরে ভিতরে আমার এই হাসি দেখারই লোভ।
আরো একটু বড় হতে বইয়ের তাগিদ।আজ ওমুক দিদিমণি তোমার একখানা বই চেয়েছে মামাবাবু, সকালে তো মায়ের জ্বালায় আসার সময় পাই না, আজই দিয়ে রাখো।
সঙ্গে সঙ্গে আমিও গম্ভীর।-বই নেই।
–বা রে, কাল একটা বই না নিয়ে গেলে আমার যে মান-ইজ্জৎ থাকে না।
–কি থাকে না? আবার বলতো?
থতমত খেয়ে হেসে ফেলে। একদিন প্রস্তাব করেছিলাম, আমি ঘড়ি দেখছি, তুই যদি আমার সামনে দাঁড়িয়ে টানা দু মিনিট হাসতে পারিস, তাহলে একটার বদলে দুটো বই পাবি।
শোনামাত্র সে-কি হাসি। হাসির চোটে চোখ মুখ লাল।-তুমি কি যে বলো মামাবাবু, ঘড়ি ধরে কেউ হাসতে পারে, আমি কি পাগল…! আবার হাসি আর ছুট।
এই মেয়ের নাম হাসি ছাড়া আর কিছু হতে পারে! যত দিন যায় নিজেই নিজের বিবেচনার তারিফ করি।
স্কুলের পাট শেষ হবার আগে থেকেই হাসির শাড়ি পরার ঝোঁক। চোখের সামনে মেয়েটা এর ফলে যেন হুট করে এক লাফে বেশ খানিকটা বড় হয়ে গেল। স্বাস্থ্য ভালো, লম্বা গড়ন, শাড়ি পরলে হাসি-খুশি মেয়েটাকে আরো সুন্দর দেখায় অবশ্য। তবু বলেছিলাম দশ ক্লাশ শেষ না হতেই শাড়ি কেন, আরো একটা দুটো বছর ফ্রক ট্রক চালিয়ে গেলেই পারতিস। কলেজের মেয়েরাও আজকাল শাড়ি পরতে চায় না–
হাসির সব কথাতেই হাসি।কত ঢ্যাঙা হয়ে গেছি তোমার চোখ নেই! স্কুলের ঢ্যাঙা মেয়েরা শাড়ি পরে দেখে আমিও ধরে ফেললাম। তুমি আবার মা-কে কিছু। বোলো না বাপু, এমনিতেই বলে আমার দিকে তাকালে তার চোখে এখন কাটা ফোঁটে।
মায়ের চোখের খবর ঠিক রাখি না, কিন্তু পাড়ার নতুন বয়সের ছেলেগুলোর চোখের ভাষার কিছু তারতম্য বুঝতে পারি। সময়ে অসময়ে তাদের অনেককেই ও বাড়ির কাছাকাছি ছোঁকছোঁক করে ঘুরে বেড়াতে দেখি। হাসিকে বাড়ি থেকে বেরুতে দেখলে বা বাড়িতে ঢুকতে দেখলে কেউ চকিত হয়, কেউ মুখখানা গম্ভীর করতে চেষ্টা করে, দুঃসাহসী দুই একজন ওকে থামিয়ে কিছু কথাবার্তা কইতেও চেষ্টা করে। হাসির কাছে ছেলেগুলোর এই আচরণ ভারী কৌতুকের ব্যাপার মনে হয়। কিন্তু দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে তখন আমাকে দাঁড়ানো দেখলে খুব লজ্জা পায়। ওর মুখের এই লজ্জার হাসিটুকু ঠিক ঠিক বর্ণনা করার মতো কলমের জোর নেই। শুধু ভাবি মেয়েটার হাসি নাম সার্থক।
ওদের স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুবার পরে হাসি দিন কতক বাড়িতেই সেঁধিয়ে থাকল। চার নম্বরের জন্য ফার্স্ট ডিভিশন হয়নি। ওর মা এসে জানান দিল, বাড়িতে বলছে লজ্জায় মামাবাবুকে আর মুখই দেখাতে পারবে না। দিন তিনেক না যেতে আবার ওর মায়ের মুখেই এক তাজ্জব খবর। হাসির বিয়ে। গত পরশু বিকেল সাড়ে তিনটেয় ছেলের পক্ষ এসে মেয়ে দেখে গেছে। ছেলের বাবা-মা নেই। বড় দুই দাদা, তাদের দুই বউ আর এক ছোট বোনকে নিয়ে ছেলে নিজেই হাসিকে দেখে গেছে। পছন্দ হয়েছে সেদিনই বোঝা গেছে। আজ সকালে এসে পাকা কথা দিয়ে গেছে। এটা জ্যৈষ্ঠ মাস, এই আষাঢ়েই তাদের ছেলের বিয়ে দেবার ইচ্ছে। মেয়ের মায়ের অর্থাৎ মনোরমার মাথায় এখন ভাবনার আকাশ ভেঙে পড়েছে।
ভাবনার কথা বলল বটে, কিন্তু মুখখানা খুশিতে ডগমগ মনে হল। হঠাৎ এ খবর শুনে আমার মাথায় বরং দুশ্চিন্তা একটু।–সবে স্কুল ফাইনাল পাস করল, এরই মধ্যে বিয়ে…ছেলে কেমন ভালো করে খোঁজ-টোজ নিয়েছ?
-তা আর নিইনি, আমাদের কাছে সোনার টুকরো ছেলে, বি. এসসি পাস, সরকারী চাকরি, রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টে কি একটা পোস্ট-এ আছে বলল, এরই মধ্যে ছশ টাকাব ওপর মাইনে পায়, আর প্রায়ই টুরফুরে যেতে হয়, তাতেও মাসে শ-দেড়শ থাকেই দাবি-দাওয়া বলতে গেলে কিছুই না–ছেলে এখানে বিয়ে করবে বলতেই তার দাদারা উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে এসেছে–ওর এক জ্যাঠতুতো ভাইয়ের চেনা পরিবার–তারাই সম্বন্ধটা দিয়েছিল, খুব ভালো বলেছে।
জিগ্যেস করলাম ছেলের বয়স কত?
-পঁচিশ। তা হাসিও তো ষোল পেরিয়ে সতেরোয় পা দিতে চলল, এমন কিছু খারাপ হবে না। আপনি যেন ওকে ডেকে একটু উৎসাহ দেবেন দাদা, এমনিতেই সকাল থেকে আমাকে ঝাড়ছে, আপনি খুব খুশি হয়েছেন না বুঝলে ঠিক বিগড়ে যাবে।…এ-দিকের শরীরের অবস্থা তো জানেন, ভালোয় ভালোয় বিয়েটা দিয়ে ফেলতে পারলে একটা বড় দায় শেষ।
শেষেরটুকু যুক্তির কথাই বটে। এই বয়েসেই ওর স্বামী নয়নের ছোটখাট একটা হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে।
সেই বিকেলেই হাসি এলো। হয়তো বা লজ্জাতেই বেঁকে-চুরে সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি সঙ্গে সঙ্গে দারুণ গম্ভীর।–আয়, সেকেন্ড ডিভিশনে সেকেন্ডারি পাস করে আমাকে মুখ দেখাতে পারছিস না, আর তার মধ্যে দিব্যি আর একজনকে মুখ দেখিয়ে মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিলি!
হাসি বলে উঠল, আমার বয়ে গেছে মুৎ ঘোরাতে, একটা ভোদকা
শুনে ধাক্কা খেলাম একটু।–সে কি রে! আমি তো শুনলাম খুব ভালো ছেলে।–তোর পছন্দ হয়নি?