সময় হয়েছে মনে হতে গুরুর ড্রয়ার খুললাম। খাপ থেকে তার সোনালি বাঁটের বিলিতি ক্ষুরটা বার করলাম। গুরু বরাবর নিজের এই ক্ষুরে কামাতে ভালবাসে। গুরুর পাশে বসলাম। বাঁ হাতে তার বালিশটা ঘাড়ের একটু তলার দিকে নিয়ে এলাম। তারপর সেই হাতেই থুতনিটা একটু ওপরের দিকে ঠেলে বললাম, গুরু মুখখানা একটু ওপরের দিকে তোলো তো
চোখ খুলতে না পেরে গুরু খুব অস্পষ্ট গলায় জড়িয়ে জড়িয়ে বলতে চেষ্টা করল, কি করবি…
-তোলোই না, যা করব তুমি টেরও পাবে না। থুতনি আরো ঠেলে তোলার কাজটা আমিই করলাম। তারপর চেপে ধরে চোখের পলকে যা করার করে ফেললাম। ফিনকি দিয়ে এক ঝলক রক্ত আমার চোখে মুখে দাড়িতে আর জামায় লাগল। কিন্তু নিশ্চিন্ত না হওয়া পর্যন্ত আমি থামি কি করে? কসেকেই বা লাগল। গুরু বার কয়েক মাত্র হাত-পা ছুঁড়ল। আধ-কাটা খাসীকে আমি এর থেকে ঢের বেশি পা ছুঁড়ে দাপাতে দেখেছি। নেশার জন্য অত পারে নি কি, কি জন্য আমি জানি না। আমার দুহাতে লালে লাল। ফরাস রক্তে ভেসে যাচ্ছে। গুরুর রক্ত যে এমন বিষম লাল আর এত গরম কে জানত। ছুটে বাথরুমে এলাম। ভালো করে মুখ হাত ধুলাম। জামাটা খুলে পুঁটলি করলাম। আমার হাতে সময় খুব নেই জানি। পুলিশ ধাওয়া করার। আগে বাড়ি গিয়ে শিবু কাকার তরুণের মন লিখে ফেলতে হবে।
রিকশা চেপে বাড়ি চলে এলাম। লিখতে বসলাম।…যা বলছিলাম, ওই বীভৎস রঙিন পোকাটা বারমুডা লিলির কাছে পৌঁছে যাবে এ কেমন করে হয়? কি করে হয়? অথচ পরশু মাঝরাতে আমি সেই স্বপ্নই দেখে উঠলাম। দেখলাম সেই সবুজ ডাটা বেয়ে বেয়ে ওটা সত্যি উঠছে। উঠছেই। যত উঠছে ততো ওটার দুচোখ আরো লোলুপ বীভৎস হয়ে উঠছে। প্রায় ডগা পর্যন্ত উঠতে একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল। তারপর সকালে গুরুর ওখানে যাওয়া পর্যন্ত জেগে জেগেই। কতবার যে ওই স্বপ্নের দৃশ্যটা দেখলাম ঠিক নেই। বাঁকা চোরা আট দশটা লিকলিকে পা বার করে ওটা উঠেই চলেছে।
কিন্তু তা কি কখনো হয়? হতে পারে? এখন আমি নিশ্চিন্ত। ওই লোলুপ বীভৎস রঙিন পোকাটা কোনো দিন আর বারমুডা লিলির নাগাল পাবে না।
কোনদিন না! কখনো না!
রূপসী বাংলার মুখ
মেয়েটাকে চোখের ওপর বড় হতে দেখেছি। ঢলঢলে মিষ্টি মুখ। না কালো না ফর্সা। চোখ দুটো ভারী সুন্দর। না হাসলেও মনে হয় চাউনিতে একটু হাসির মায়া ছুঁয়ে আছে। নামও হাসি। ছ মাস বয়েস হতে ওর মা মনোরমা একদিন মেয়ে কোলে আমার কাছে হাজির। মুখে চিন্তার ছায়া। বলল, আপনার ভাগ্নীর তো ছ মাস হয়ে এলো দাদা, এ-মাসের শেষেই মুখে একই মায়ের প্রসাদ দেব ভাবছি, কিন্তু এখনো পর্যন্ত একটা নামই ঠিক হল না–আজ আপনার কাছ থেকে ওর একটা নাম না নিয়ে নড়ছি না।
মেয়ের একটা নাম ঠিক করে দেবার তাগিদ এ পর্যন্ত ওর মা আমাকে অনেকবার দিয়েছে। তখন পর্যন্ত বাচ্চাটার বাবা ওকে আদর করে ডাকত বুচু। ওই ডাক শুনে পিত্তি জ্বলে যায় এ-ও মনোরমা নিজেই অনেকবার বলেছে। মেয়ে খাদা নয় বোঁচা নয় তবু বুচু বলে ডাকলে কোন মায়ের ভালো লাগে!…ভাবতে গেলে মনে হয় সেদিনের কথা, মেয়ে কোলে মায়ের আক্ষেপ, পাড়ার সকলেও এখন বুচু বুচু শুরু করেছে, শেষে ও-ই না ডাক-নাম হয়ে দাঁড়ায়। আপনি এমন একটা নাম দিন দাদা যাতে ভালো নাম ডাক-নাম দুই-ই হয়ে যায়। আমি ওকে বলে দিয়েছি, দাদা নাম ঠিক করে দিলে মেয়েকে আর কোনো নামে ডাকা চলবে না।
ওকে অর্থাৎ ওর স্বামী নয়নকে বলে দিয়েছে। ওরা বসু চৌধুরী। আমি এদের দাদা হলেও আত্মীয়তার কোনো যোগ নেই। লাগোয়া পুরনো দোতলা বাড়িটা ওদের। পৈতৃক ভিটে। দোতলার দুখানা ঘরে ওরা থাকে। জোরে কথা কইলে বা শব্দ করে হাসলে-কাদলে আমাদের বাড়ির ও-মুখো ঘর থেকে শোনা যায়। একতলার ঘর দুটো পুরনো ভাড়াটের দখলে। নামমাত্র ভাড়া পায় বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু এতকালে তারাও আত্মীয়ের মতো হয়ে গেছে, তাই মুখ ফুটে কিছু বলে না বা বলতে পারে না। ওপর-নিচের দুই পরিবারই নিজেদের সুখে-দুঃখে আমাদের আপনার জন ভাবে।
পঁয়ত্রিশ বছর হয়ে গেল, নামের তাগিদে ছ মাসের মেয়ে কোলে মনোরমার। সেই ঘরে এসে চড়াও হওয়াটা স্পষ্ট মনে আছে। যার কোলেই হোক, ঘরে এলেই মেয়েটা আমার টেবিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। লেখার কাগজ কলম বই-পত্র রহস্যজনক খেলার কিছু ভাবে হয়তো। কিন্তু মায়ের কোলে চেপে সেদিন সামনে না ঝুঁকে মুখের দিকে চেয়ে ফিক-ফিক করে হাসছিল। ও-যেন আমার ফ্যাসাদ বুঝেই মজা পাচ্ছে।
মেয়েটার হাসি দেখেই মনে হয়েছিল এই নামটা আমার অনেক আগেই মনে আসা উচিত ছিল। একটুও না ভেবে বলেছিলাম, মেয়ের নাম রাখো হাসি।
অনেকদিনের প্রত্যাশার পরে লেখকের কাছ থেকে এমন সাদামাটা নাম আশা করেনি মুখ দেখেই বোঝা গেল। বলল, শুধু হাসি…
–হাসি আবার শুধু হাসি কি, চোখ বুজে নামটা রেখে ফেলো, ও-নামের কদর পরে বুঝবে।
মেয়েটাও ও-কথার পরেই জোরে হেসে উঠেছিল মনে আছে।
পছন্দ হোক না তোক মনোরমা মেয়ের নাম হাসিই রেখেছে। আর ওর আত্মীয় পরিজন বা চেনা-জানা কাউকেই বোধহয় জানাতে বাকি রাখেনি মেয়ের এই নাম ওমুক দাদা রেখেছে।
তারপর দিনে দিনে মাসে মাসে বছরে বছরে হাসি আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছে। বিকেলে আর ছুটির দিনের দুবেলাই ওদের বাড়ির সামনের কাঁচা উঠোনে অন্য মেয়েদের সঙ্গে ছোটাছুটি করে, এক্কা-দোক্কা খেলে, লাফাঝাপি করে আর সমবয়সী সব মেয়ের ওপরেই সর্দারি করে। হঠাৎ হঠাৎ মুখ তুলে ওপর দিকে তাকায়। ও ঠিক বুঝতে পারে দোতলার রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে অনেক সময়েই ওকে আমি লক্ষ্য করি। ঝগড়াঝাটি করা বা সর্দারি করাও লক্ষ্য করি। তখন লজ্জা পায় আর খুব হাসে। সকালে স্কুল-বাসের হর্ন শুনলেই বই-খাতার ব্যাগ বুকে চেপে পড়ি-মরি করে ছুটে আসে, আর তখনো একবার তাকিয়ে দেখে দোতলার রেলিং-এ আমি দাঁড়িয়ে কিনা। ওর দৌলতে বাসের মেয়েরাও ওর মামাবাবুকে অর্থাৎ আমাকে চিনে গেছে, সকৌতুকে তারাও চেয়ে চেয়ে দেখে। কোনো কারণে পর পর দু-তিনদিন আমাকে না দেখলে হঠাৎ এক সময় আমার ঘরে এসে চড়াও হয়। গিনি গিন্নি মুখ।-বা-ব্বাঃ! এত লেখায় ব্যস্ত যে কদিনের মধ্যে দেখাই নেই, আমি ভাবলাম জ্বর-জ্বালা হল নাকি আবার দেখে আসি