চেয়ার ঠেলে সমর ঘোষাল উঠে দাঁড়ালো। ঠোঁটের ফাঁকে একই রকমের মৃদু হাসি, শোভনার দিকে চোখ।–অনুমতি হলে আমি স্বস্থানে ফিরি-এর (অতসীর) ক্ষতি হচ্ছে, পড়াশুনার ব্যাপারে খুব সীরিয়াস এখানেও দেখেছি, ন্যাশনাল লাইব্রেরিতেও লক্ষ্য করেছি।
তেমনি মৃদু হেসে অতসী জবাব দিল, কপাল গুণে আমার গোপাল ঠাকুরের পূজা আর্চা সবই লাইব্রেরিতে…বাড়িতে সময় হয় না।
দাঁড়িয়ে শুনল, দেখলও একটু, কিছু জিগেস না করে ফিরে গেল।
–যা! শোভনার গলায় হতাশা, ভেবেছিলাম যত জমাটি মগজই হোক, আগুনের আঁচে এনে ফেলতে পারলে একটু গলগলা ভাব দেখব, কিছুই তো দেখা গেল না!
–আর জ্বালাসনে বাপু, পড়তে হয় পড়। নয়তো পালা, এ চ্যাপ্টারটা আজ শেষ করতেই হবে।
শোভনার অত ধৈর্য নেই, তাছাড়া বাড়ির গাড়ি অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। উঠে পড়ে বলল, এখন চ্যাপ্টারের চাপে বসে বসে চ্যাপ্টা হ, তারপর ট্রাম-বাসের। ভিড়ে চ্যাপ্টা হওয়া আছেই–আমি বাপু সত্যি আর বসে থাকতে পারছি না।
এর পরেও অতসী আর সমর ঘোষালের দেখাসাক্ষাৎ যেটুকু এই লাইব্রেরিতে বা ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। য়ুনিভার্সিটিতে কথাবার্তা বলতে গেলে হয়ই না। মুখোমুখি বা সামনাসামনি পড়ে গেলে সমর ঘোষাল হেসে মাথা নাড়ে। অতসীও একই জবাব দেয়। কথা টুকটাক ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে দেখা হলে হয়। ফেরার সময় কিছু পথ হেঁটে দুজনেরই ট্রাম বা বাস ধরতে হয়। তারপর দুজনের পথ দুদিকে। সমর ঘোষাল থাকে, মধ্য কলকাতায়, অতসী দক্ষিণে। অতসী প্রায় প্রত্যেক ছুটির দিনেই ন্যাশনাল লাইব্রেরি আসে, সমর ঘোষাল মাঝেমধ্যে। এইটুকু দেখাসাক্ষাৎ বা কথা-বার্তার ফাঁকে বাড়তি আগ্রহের ছিটেফোঁটাও কেউ দেখেনি। দশ মিনিটের হাঁটা। পথ ট্রাম-বাস পর্যন্ত পাশাপাশি আসার মধ্যেও সহজ ব্যক্তিত্বের ফারাক একটু থেকেই যায়। অতসীর এটুকুই খুব পছন্দ। গরীব ঘরের সুরূপা মেয়ে এযাবত পুরুষের হ্যাংলামো অনেক দেখেছে।
তবে ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে ফেরার সময় এটুকু পথ এক সঙ্গে আসে দুজনে। সমর ঘোষালের আগে হয়ে গেলে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়, হাসিমুখে জিগেস করে, কত দেরি? অতসীর প্রায়শঃ একই জবাব, আর দুমিনিট অপেক্ষা করো। বা, আর পাঁচ মিনিট। আবার ওর আগে হয়ে গেলে ঝোলা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে হাসি-হাসি মুখে তার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় কেবল, কিছুই জিগেস করে না। সমর ঘোষাল চটপট উঠে পড়ে। স্বাভাবিক সৌজন্যে আগে ওকে ট্রামে তুলে দিয়ে (চাপাচাপির ভয়ে অতসী পারতপক্ষে বাসে ওঠে না) নিজের ট্রাম বা বাস ধরে।
এটুকুর মধ্যে দুই একটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের টুকটাক কথাও হয়। এর মধ্যে সমর ঘোষাল একদিন জিগেস করেছিল, আচ্ছা, তোমার সব পড়াশুনা লাইব্রেরিতে, বাড়িতে একদম সময় পাও না বলেছিলে…কেন, অন্য কিছু শেখটেখ নাকি?
অতসী হেসেই জবাব দিয়েছিল, শিখি না, শেখাই। সপ্তাহে তিন দিন করে সন্ধ্যার পর দুটো মাড়োয়ারি বাড়িতে টিউশনি করি। তারা লোক ভালো, কেবল কামাই পছন্দ করে না। রাত্রিতে তারপরেও নোট-টোট বা লেখা-টেখা নিয়ে বসি-ফলে ঘুমোতে দেরি, সকালে উঠতেও দেরি–আর তার ফলে স্নান-টান সেরে নাকে-মুখে কিছু গুঁজে যুনিভার্সিটিতে ছোটার তাড়া–কম করে এক ঘণ্টার পথ তো।
শোনার পর একটু শ্ৰদ্ধার ভাবই লক্ষ্য করেছে অতসী। চেহারা বা ছিমছাম বেশ বাস দেখে গরীব ঘরের মেয়ে কেউ ভাবে না। চলতে চলতেই সমর ঘোষাল মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়েছে।–দুদুটো টিউশনি কত দিন ধরে করছ?
–বি, এ পড়তে ঢোকার সময় থেকেই।
পরের বিস্ময়টুকুও নির্ভেজাল মনে হয়েছে অতসীর।–এই করে বি. এ-তে ইকনমিক্স-এর মতো সাবজেক্ট নিয়ে সেকেন্ড ক্লাস সেকেন্ড–দারুণ তো!
শুনে মনে মনে সত্যিই খুশি অতসী, কারণ সেকেন্ড ক্লাস সেকেন্ডের খবরটা ও নিজে কখনো দেয়নি। মুখ টিপে হেসে বলল, তোমার ইংরেজিতে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার থেকেও কঠিন মনে হচ্ছে?
হেসে উঠল, ও একটা হয়ে গেছে…এবারে যে কি হবে ভাবতে গেলে ভয়। করে বলে ভাবি না।
এমন শুনলে উৎসুক হবারই কথা।-কেন?
-আর বলো কেন, আমার বাইরেটাও খেলার মাঠ, বাড়িতেও খেলার মাঠ…গেল বার বেঙ্গল টিমে চান্স পেয়ে কি যে ক্ষতি হয়ে গেল সে-কেবল আমিই বুঝছি।
খেলার সমঝদার অতসী আদৌ নয়। তবু মুখে বলল, নামী খেলোয়াড় হওয়াও কম কথা নয়।
আবার হাসি। আমার দৌড় আমি তো জানি। হাজার খেলি, কোনদিন গাভাসকার বা কপিলদেব হতে পারব না। এর থেকে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়াটা অনেক সহজ ছিল, কিন্তু বাড়িতে খেলার মাঠের শুভার্থীদের হামলায় দুদিকই ফসকাবার দাখিল। সব নয়, এর মধ্যে একটা কথাই কুট করে কানে লাগল অতসীর।…খুব অনায়াসে বলতে পারল, এর থেকে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া অনেক সহজ ছিল। তা-ও এম, এ-তে আর ইংরেজি সাবজেক্ট নিয়ে। অতসীরও আত্মবিশ্বাস সব থেকে বড় পুঁজি। সে-ও অনেক সময়। ভেবেছে, ওই দুদুটো টিউশনি করতে না হলে সে-ও ইকনমিক্স-এ ফার্স্ট ক্লাস পেতে পারত।..সবে ফিফথ ইয়ার, ফাইনালের এখনো ঢের দেরি, এখনো অতসীকে যদি কেউ টিউশনি থেকে অব্যাহতি দেয়, সে কখনও এমন অনায়াস জোরের সঙ্গে বলতে পারবে না, এবারে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়াটা সহজ ব্যাপার।…ইকনমিক্স-এ ফার্স্ট ক্লাস ফি বছর একজন ছেড়ে দুতিন জনও পায়, কিন্তু ইংরেজিতে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়াটা তার বিবেচনায় ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ার ব্যাপার, অনন্য প্রতিভাধরও ওই বিষয়ে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া সহজ বলতে পারবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু যে বলল, সে একবার ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে দেখিয়ে দিয়েই বলল, এটা বৃথা আস্ফালনের পর্যায়ে ফেলার অজুহাত ভাবা যায় না।