তারা নামার আগেই ব্যাণ্ডোদা সরে গেছল। তার বাবাকে বলেছে, তোমার গাড়িটা নিয়ে ঘণ্টাখানেকের জন্য বেরুচ্ছি। রাতে তার বাবা কলেও বেরোয় না গাড়ির ও দরকার হয় না।
মা মেয়ে খানিকটা এগোবার পর পিছন থেকে গাড়ি থামিয়ে ব্যাণ্ডোদা তাদের ধরেছে। নেমে এসে পিছনের দরজা খুলে দিয়ে মহিলাকে বলেছে, উঠুন মাসিমা –পৌঁছে দিচ্ছি।
মা মেয়ে দুজনেই খুব হকচকিয়ে গেছে। মহিলা বলেছে, আমরা তো বাগবাজারে থাকি
ব্যাণ্ডোদা বলেছে, গাড়িতে বাগবাজার আর কতক্ষণের পথ। আর বলেছে, পুরনো বান্ধবীর সঙ্গে বাগবাজার থেকে এসে আপনি কেমন দেখা করলেন আমি দেখেছি, আর বুঝেছি, এমন জানলে আপনি আসতেন না। তাই আমিই যেটুকু পারি প্রায়শ্চিত্ত করি–উঠুন উঠুন পিছনে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে।
মহিলা তাড়া খেয়ে উঠে বাঁচল। মেয়েটা আদব-কায়দা জানে না বলে সেও মায়ের পিছনে উঠল। গাড়ি হাঁকিয়ে সামনে চোখ রেখেই ব্যাণ্ডোদা আলাপ জুড়ে দিল। আর। ফাঁকে ফাঁকে রিয়ার গ্লাসে মেয়েটাকে দেখতে লাগল। সংকোচ কাটিয়ে মহিলা বলল, তুমি এভাবে গাড়িতে আমাদের পৌঁছে দিতে চললে, তোমার মা হয়তো অসন্তুষ্ট হবেন।
ব্যাণ্ডোদা বেশ গলা ছেড়ে হাসল (ওটা সরলতার লক্ষণ জানে), জবাব দিল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন মাসিমা, আমাদের কারো ব্যাপারে কারো ইন্টারফিয়ার করা রীতি নয়–একদিক থেকে আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। তা আমার মায়ের সঙ্গে এককালে খুব ভাব ছিল বুঝি আপনার?
-খুব। এই জন্যেই তো…
কিছু বলতে গিয়ে থমকালো। আবারও হা-হা হেসে ব্যাণ্ডোদা বলল, আপনাকে কিছু লজ্জা পেতে হবে না, আমি একনজরেই সব বুঝে নিয়েছি। মা অনেক বদলেছে, অনেক বড়লোক হয়েছে। তবে আমার শুধু অনুরোধ বাবা মাকে দেখে আপনি তাদের ছেলেকে বিচার করবেন না। মায়ের আচরণে আজ আমি কোথায় আঘাত পেয়েছি। জানলে আমার জন্য আপনার কষ্ট হত।
মহিলা বলেছে, সে-কি কথা বাবা, আমি এরই মধ্যে বুঝেছি তুমি সোনার ছেলে।
বাড়িতে পৌঁছে দিতে গিয়ে ব্যাণ্ডো দেখেছে, নিতান্তই দীন দশা তাদের। ভদ্রলোক.. হয়তো বড় তিন মেয়ে পার করতেই ফতুর হয়েছে। মেয়েগুলোর চেহারা খাসা বলে। তবু পার হয়েছে। ভদ্রলোক সত্যিই প্রায় অথর্ব। একবার: ডায়বেটিক স্ট্রোক পর্যন্ত। হয়ে গেছে। তাকে দেখার কর্তব্যেই ব্যাণ্ডোদা এরপর: ঘন ঘন এসেছে। তাদের চোখে সে তখন আর সোনার ছেলে নয়, হীরের টুকরো ছেলে। হ্যাঁ, মহিলা ততদিনে তারও খোঁজ খবর সব নিয়েছে বইকি। অবশ্য ব্যাণ্ডোদার কাছ থেকেই। গেলেই একরাশ ফল মিষ্টি নিয়ে যায়। মহিলা কিছু বলতে গেলে অভিমান করে, আমাকে ছেলে ভাবলে কিছু বলবেন না, আমার মা আছে, কিন্তু আপনাকে দেখার আগে আমি মা পাইনি।
পাঁচ দিন আগে ব্যাণ্ডোদা তিন হাজার টাকা জোর করে মহিলার হাতে গুঁজে দিয়েছে–মেসোমশাইয়ের সব থেকে ভালো চিকিৎসা হওয়াই চাই। মহিলা তিন হাজার টাকা একসঙ্গে দেখেছে বলে মনে হয়নি ব্যাণ্ডোদার। তার যে দেবার অধিকার আছে তার দুদিন আগে মহিলাকে সে সেটা স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, আমাকে যদি খুব অপছন্দ না হয়, তাহলে যেদিন বলবেন সেদিন আমি গাড়ি নিয়ে এসে আপনাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যাব…অবশ্য আমার ব্যাপারে আমার ডিসিশনই ফাইন্যাল, তবু একটা ফরম্যালিটির ব্যাপার আছে তো। আমি মাকে বলেই রেখেছি, ওঁদের আপত্তি না হলে চন্দনাকে বউ করে ঘরে তোলার জন্য রেডি থেকো।
মহিলা তো আকাশের চাঁদ হাতে পাবেই। মা রাগ করেছে কিনা জিজ্ঞেস করতে ব্যাণ্ডোদা আবার সেই হা-হা হাসি হেসেছিল বলেছিল, এবারে গিয়েই দেখতে পাবেন। তাছাড়া জানেন তো কারো ব্যাপারে ইন্টারফিয়ার করা আমাদের রীতি নয়।
যাক, ব্যাণ্ডোদার অভিমান দেখেই মহিলা সেই তিন হাজার টাকা হাত পেতে নিয়েছে। তারপর এইসব ছবি-টবি তুলতে দিতে আর বাধা কোথায়। ব্যাণ্ডোদার আফসোস, ওই দুটো খুপরি ঘর, চন্দনাকে সেভাবে একলা পাচ্ছে না–তবে পাবার চান্স এবারে একটু হয়েছে। ব্যাণ্ডোদা বলল, মেয়েটা এখনো এমন চেয়ে থাকে না, যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না কি হতে যাচ্ছে। তখন ইচ্ছে করে, ওকে বুকের মধ্যে নিয়ে একেবারে পিষে ফেলি, আর টসটসে চোখ দুটো দাঁতে করে ছিঁড়ে আনি।
ওরা পৌঁছুলো। কুণাল দেখল মেয়েটাকে। ছবি অত সুন্দর, কিন্তু এর বুঝি তুলনা নেই। দেখামাত্র সদ্যফোঁটা যুঁই ফুলের মতো মনে হল কুণালের। আড়চোখে কুণালকেও দেখল। ঠোঁটের ফাঁকে হাসির দাগ পড়ল একটু। ছাগলদাড়ি দেখে হাসি পাচ্ছিল। বোধহয়। যে-লোকের বন্ধু, কুণালেরও আদর যত্ন কম হবে কেন? যতক্ষণ ছিল ওরা, চন্দনার মায়ের অস্থির অস্থির ভাব। এরই মধ্যে ফাঁক বুঝে ব্যাণ্ডোদা বার দুই চোখে চোখে কথা কইতে চেষ্টা করল চন্দনার সঙ্গে। কিন্তু চন্দনার আয়ত গভীর কালো চোখে আর দুটো ঠোঁটের ফাঁকে একটু হাসির আভাস খেলা করে গেল শুধু। আর খেয়াল না করে ব্যাণ্ডোদা একটু কাছাকাছি হতে চেষ্টা করলেই তেমনি খেয়াল না করেই যেন ওই মেয়ে একটু তফাতে সরে যায়। দুবার হয়েছে এমন। আ-হা-হা, কুণালের চোখে পলক পড়ে না–কি যে দেখাচ্ছিল না মেয়েটার মুখখানা তখন–যেন একখানা কালো মেঘের সঙ্গে চাঁদের লুকোচুরি খেলা। উপমা ঠিক হল না। চাঁদ হাসে। এই মেয়ের মুখে শুধু একটু হাসির আভা ছড়ায়।