গুরু বলল, এগুলো কেমন মোটা লাভে ঝেড়ে দিই দেখিস–তোকেও লাভের কিছু ভাগ দেব। আর ওই দুটো দোকানের মালিকের সঙ্গেও তোর আলাপ করিয়ে দেব। খদ্দের আনার চৌকস লোক তো তাদের সব সময়ই দরকার হয়। কুণাল বোস এখন এই দালালির কাজে পাকা হয়ে গেছে। কাঁচপোকার মতো খদ্দের ধরে নিয়ে আসে। আবার নিজেও ঘুরে ঘুরে বেশি লাজুক খদ্দেরের কাছে সাপ্তাহিক ভাড়ায় ছবি আর পর্ণোগ্রাফির বই পৌঁছে দেয়। এই খদ্দেররাই আবার কদিন গেলে পরদায় মুভি ব্লু ফিল্ম দেখার আশায় ওকে তেল দেয়।
অকাতরে এর জন্যে তারা মোটা টাকা খরচ করে। কুণালের ঝোঁপ বুঝে কোপ, অর্থাৎ খদ্দেরের পকেটের ওজন বুঝে মাশুল আদায়। এই করে দালালির রোজগার বাড়ছেই। অথচ এক বছর আগেও কি জানত ওই দুটো দোকানেরই গোপনে মুভি ব্লু ফিল্ম দেখানোর এমন পরিপাটি ব্যবস্থা আছে?
যা ভেবেছিল তা নয়। গুরু চিৎপাত হয়েই তার এক্সক্লসিভ নিজের ঘরের ফরাসে শুয়ে আছে। তার পাশে দুটো পোস্টকার্ড সাইজের ফটো পড়ে আছে, হাতেও একটা খুব মনোযোগ দিয়ে সেই ফটো দেখছে গুরু!
কুণাল শব্দ না করে পাশে বসল। আলতো হাতে ওই বাকি ফটো দুটো তুলে নিল। দুটো ফটোই একটা মেয়ের। ফুটফুটে সুন্দর কচি মুখ। বড় জোর বছর সতেরো আঠারো হবে বয়েস। ডাগর চোখ। চোখের পাতা ফেললে বোধহয় নাকের ডগা অনেকটা ছাড়িয়ে যাবে। মোটাও নয়, রোগাও নয়। সব থেকে চোখে পড়ার মতো মেয়েটার মুখের কমনীয়তা। কেউ যেন ছাঁচে গড়ে কমনীয়তার রস উপুড় করে ঢেলেছে।
হাতের ছবিটা সামনে রেখে গুরু আড়চোখে কুণালকে দেখছে আর টিপটিপ হাসছে। চোখাচোখি হতে বলল, দেখে ফেললি তো! তোকে অবাক করে দেব বলে একমাস ধরে চেপে বসে আছি।
–কি ব্যাপার গুরু, এ আবার কোথাকার হরী পরী? কিন্তু এ তো একেবারে কচি!
তেমনি হেসে গুরু জবাব দিল, বাগবাজারের। হাতের ফটোটা এগিয়ে দিল। দেখে ফেলেছিস যখন এটাও দ্যাখ।
অর্থাৎ এটা কচি বলার জবাব। একটু আড় হয়ে মেয়েটা বাঁ-হাত মাথার পিছনে তুলে খোঁপা ঠিক করছে–সেই সময়ের ছবি। ফলে পিছনের খানিকটা আর বুকের। এক দিকের সুডৌল মাধুরী যেন উপছে পড়েছে। চোখ ফেরানো যায় না।
শুরু হৃষ্টমুখে জানান দিল, এ ছবিতে কোন কায়দায় কি তুলেছি ও মেয়ে নিজেও..। জানে না।…তা কি রকম মনে হচ্ছে?
দারুণ।
চোখে দেখলে রাতে তোর ঘুম হবে কিনা সন্দেহ। দেখবি?
বাগবাজারে গিয়ে?
ইদানীং তো আমি প্রায় রোজই যাচ্ছি। এই ফটোটা আমার থাকবে, আজ ওই ফটো দুটো দিয়ে আসতে যাব। চল…।
কুণাল বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত থাকে পার্ক স্ট্রীটে। সে-সময় গুরুর কোন্ লীলা চলছে জানবে কি করে। লোভ হচ্ছে বটে, আবার নেশার লোভ নিয়ে এসেছিল তা ও বাতিল করতে মন চায় না। বলল, একটু বড় গাঁজার ইচ্ছে ছিল যে গুরু…।
বড় গাঁজা অর্থাৎ মারিজুয়ানা। গুরু আমল দিল না। বলল, ও-সব এসে হবে, আগে বড় গাঁজার রাণী দেখবি চল।
গুরু তৈরী হয়ে রাস্তায় বেরুলো। ট্যাক্সি নিল! হুকুম করল, বাগবাজার।
ডায়েরি ফেরত পাওয়া বা কুণালের লেখক হবার সম্ভাবনার মজার খবরটা আর দেওয়াই হল না। ওর হাতের সেই কালো ডায়েরিটা গুরুর চোখে পড়েও পড়ল না। ট্যাক্সি ছুটেছে আর এদিকের রসের ব্যাপারখানা কি থেকে কি গড়াচ্ছে ব্যাণ্ডোদা মনের আনন্দে সেই ফিরিস্তি শোনাচ্ছে শিষ্যকে।…ওই ফটোর মেয়ের মা গুরুর মায়ের ছেলেবেলার খুব বন্ধু ছিল। একদিন দুজনের দুজনকে না দেখলে চলত না এমন নাকি। হঠাৎ এর মধ্যে একদিন কার মুখে শুনেছে সেই ছেলেবেলার বন্ধু আজ চৌদ্দ বছর ধরেই কলকাতায়। আমেরিকায় নয়। সে দিন-আনা দিন-খাওয়া গরীবের বউ আমেরিকা ফেরত এত বড়লোক বান্ধবীর কাছে আসবে কি আসবে না সেই দ্বিধা ছিল। শেষে ইচ্ছেটাই বড় হয়েছে। ফোন গাইডে ঠিকানা দেখে ছোট মেয়েকে সঙ্গে করে এক-সন্ধ্যায় চলেই। এসেছে। নিচে তখন গুরু ছিল। তার সঙ্গেই মা-মেয়ের প্রথম দেখা। সে-যে কি দেখা গুরুই জানে। এত বড় বাড়িতে পা ফেলে দুজনেই তারা বেশ জড়সড়। চন্দনা। মানে ফটোর মেয়ে সেদিন একখানা ঘন নীল শাড়ী পরে এসেছিল। গুরুর মনে হচ্ছিল, নীলের মধ্যে আকাশের চাঁদখানা মুখ বাড়িয়ে আছে।
কাকে চাই শুনে সঙ্গে করে দোতলায় নিয়ে চলল। বাবা মা তখন মুখোমুখি বসে মদ গিলছে জেনেও। ছেলেবেলার বান্ধবী শুনে আর নিরাভরণা মহিলার একেবারে সাদামাটা বেশবাস দেখেই তার মগজে একটা আশা উঁকি ঝুঁকি দিয়ে গেছে। বান্ধবীকে স্বামীর সঙ্গে মদের বোতল আর মদের গেলাস নিয়ে বসা দেখেই তো মহিলার হয়ে গেল। ওদিকে বাবা-মাও অবাক। গুরুই ভিতরে ডাকল, আসুন মাসিমা ভিতরে আসুন। মা-কে বলল, তোমার ছেলেবেলার বন্ধুকে চিনতে পারছ না?
নাম বলার পরেও ব্যাণ্ডোদার মায়ের চিনতে সময় লাগল একটু। বাবা সাহেবী কায়দায় নিজে উঠে ওদের বসতে আপ্যায়ন করল। তারপর অন্য ঘরে চলে গেল।ওরা জড়সড় হয়ে বসল। ব্যাণ্ডেদা বাইরে থেকে লক্ষ্য করল, চেনার পরেও মা তেমন আগ্রহ দেখালো না। ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞেস করল, ড্রিংক চলে কিনা। মহিলা এমন মাথা নাড়ল। যে বাইরে থেকে ব্যাণ্ডোদা হেসেই ফেলল। সে যেন উঠে ওই ঘর ছেড়ে ছুটে বেরুতে পারলে বাঁচে। দুচার কথায় মা তার ঘরের খবর নিল। মহিলা বাগবাজারে থাকে।চন্দনারা চার বোন। চন্দনা ছোট। বড় তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী পোস্ট অফিসের চাকরি থেকে এ বছরেই রিটায়ার করেছে, এখন ডায়বেটিসে প্রায় শয্যাশায়ী। মায়ের জেরার মতো প্রশ্নে দুই এক কথায় এইসব জবাব এসেছে। একটু বাদেই মহিলা বলল, উনি গেলাস রেখে চলে গেলেন, আমি অসময়ে এসেছি, আজ উঠি। ব্যাণ্ডোদার মা আপত্তি করল না, মাথা নাড়ল। ওরা উঠতে বলল, তোর এই ছোট মেয়েটা তো বেশ সুন্দর হয়েছে, বিয়ের চেষ্টা করছিস নাকি? মহিলা মিনমিন করে জবাব দিল, সে-রকম কিছু না, সবে এবার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিল…এখনো ফল বেরোয়নি…বয়েস মাত্র সতের।