-তারপর আমার ভাগের পালা শুরু। যত রকমের ভোগ এই পৃথিবীতে আছে। সব আমার হাতের মুঠোয়। সদয় ভোগ, নির্দয় ভোগ, হিংস্র ভোগ, অহিংস ভোগ, সচেতন ভোগ, অচেতন ভোগ। আমি এই পৃথিবীর একমাত্র ভোগরাজ।
শেষে মন্তব্য, শালা ভোগের কিছু জানো না বলেই এক কথায় নিজেকে ভোগরাজ বানিয়ে শেষ করলে। অমন ভোগে হাবুডুবু খেতেই যদি পারো–তখন মনের ঘরে মাসে দুলাখের বদলে দুশ টাকা খরচের জীবন ঢের বেশি স্বাদের মনে হবে হয়তো কিন্তু সেটা ওই ভোগের আগে নয়।
এই শেষের মন্তব্যটা শুধু গুরুর পছন্দ হয়নি। নইলে বাকিটা বেশ লেগেছিল। যাক ডায়েরির আগাগোড়া কুণাল বোসের ভিতরের মনটা এখনি ছড়ানো ছিটানো। শিবুকাকা তার লেখা একটুও ভালো বলেনি, কিন্তু মন্তব্যগুলোর মধ্যে আর সব জিনিস খুঁটিয়ে দেখার মধ্যে কিছু সম্ভাবনা দেখেছে। তবে একটা লেখার প্রশংসাই করেছে। গুরুর মতে যেটা কোনো লেখাই নয়।
লেখাটার নাম ওড অন্ এ বারমুডা লিলি।
পরীক্ষায় ফেল করুক আর যাই করুক চেঁচিয়ে পাঠ্য বইয়ের ইংরেজি বাংলা কবিতা পড়ত, ইংরেজিতে নম্বর পেত একশর মধ্যে বড় জোর তিরিশ। কিন্তু কীটসএর ওড়-অন এ গ্রীসিয়ান আরন তা বলে কম বার চেঁচিয়ে পড়েনি। কুণাল বোসের কল্পনায় এর বিষয়বস্তুও অনেকটা এক রকম। তবে কুণাল বোসের ভাব আলাদা।
..বারমুডা লিলি হল একটা ফুলের নাম। যা কুণাল কখনো চর্ম-চোখে দেখেনি। ঘরের রঙিন ক্যালেণ্ডারে দেখেছে। ক্যালেণ্ডারে লম্বা তকতকে একটা সবুজ ভঁটার ওপরে ফুটে আছে বারমুডা লিলি। তার লম্বা লম্বা সাদা মসৃণ অদ্ভূত নরম ছটি পাপড়ি। ভিতরে রঙ-বেরঙের ছটি কেশর। বিলিতি ক্যালেণ্ডারের আর্ট পেপারে ছাপা ভারী সুন্দর একটা জীবন্ত ফুল দেখলে মনে হবে ওটা শুচিতার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু ওই সবুজ ডাটা বেয়ে উঠছে রঙিন একটা বীভৎস পোকা। পোকার লুব্ধ দুটো চোখ ভঁটার মাথার ওই ফুলটার দিকে। ওই পর্যন্ত উঠে ফুলটা কুরে কুরে খেতে পারলে তার জন্ম সার্থক, জীবন। সার্থক। ক্যালেণ্ডারের ওই ছবিটার দিকে তাকালেই অদ্ভুত একটা শিহরণ হত কুণালের। ছবিটার দিকে চেয়ে থাকত আর কল্পনায় দেখত ওই রঙিন বীভৎস পোকাটা স্থির অব্যর্থ। গতিতে ওই ফুলটার কাছে পৌঁছাচ্ছে কিন্তু ফুল জানেও না কি শোচনীয় তার পরিণতি। কল্পনাটা যত ঘন হত ততো যেন গায়ে কাঁটা দিতে কুণালের, একটা অস্বাভাবিক রোমাঞ্চ অনুভব করত। সেটা দুঃখের কি বীভৎস আনন্দের ঠিক করে উঠতে পারত না। যদিও জানা কথাই ছবির ওই লোভী পোকা কোনদিনই ফুল পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবে না।
ওই ছবিটা দেখে দেখে মাথায় হঠাৎ একদিন একটা অদ্ভুত খেয়াল চাপল কুণালের। ডায়েরির পাতার মাপের এক টুকরো আর্ট পেপার কেটে নিয়ে ওই ক্যালেণ্ডার আর কাগজ, তার এক আর্টিস্ট বন্ধুর কাছে দিয়ে এলো। ক্যালেণ্ডারের ওই রঙিন ছবি আর্ট পেপারে হুবহু তুলে দিতে হবে। ক্যালেণ্ডারের ওই রং ফুল পোকা সব একরকম হওয়া চাই। ঠিক ঠিক হলে একটা ছোট বোতল তাকে প্রেজেন্ট করবে। বোতলের লোভে না হোক তাগিদের চোটে আর্টিস্ট বন্ধু তাই করে দিল। রং ফুল পোকা এক রকমই হয়েছে। সেই আঁকা আর্ট পেপারটা এনে কুণাল ডায়েরির বাঁ দিকের পাতায় সাঁটল। তারপর ডান দিকে ওড় অন এ বারমুডা লিলি লিখল।
বারমুডা লিলি, আসলে তুমি এক অনন্তযৌবনা অক্ষতসুন্দর নিষ্পাপ মেয়ে। তুমি নিশ্চিন্তে রূপের ডালি ছড়িয়ে বসে আছ। জানোও না কে তোমাকে গুটিগুটি খেতে আসছে–শেষ করতে আসছে। ও এসে পৌঁছুলে তুমি কি করবে–কেমন। চমকাবে? আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে। ভয়ের ছায়া তো আগে চলে। কিন্তু সুন্দরী, তোমার মনে কি ভয়ের ছায়াও পড়ে না? এ যৌবন ছড়িয়ে অমন নিশ্চিন্তে আনন্দে বসে আছ কি করে?…নাকি তুমি জানো, ওই নির্মম যম কোনদিন তোমার কাছে। পৌঁছুতে পারবে না–ওর লুব্ধ চোখ আর জ্বলন্ত ক্ষুধা নিয়ে ও যেমন আছে চিরকাল সেই রকমই থেকে যাবে?…তাই ঠিক বোধহয়। বাসনার চূড়ান্ত স্বপ্নের নাগাল আমরা কে কবে পেয়েছি? যার পরে আর কিছু নেই এমন ভোগবতীর কাছে কে কবে পৌঁছুতে পেরেছি? হয়তো তার হদিশ পেয়েছি, ওই ভীষণ রঙিন পোকাটার মতো লুব্ধ চোখে তাকে দেখেছি, লোভে হাত চেটেছি, গুটিগুটি সেদিকে এগোতে চেয়েছি। কিন্তু ওই বাসনার ডালি মরীচিৎকার মতো যেমন দূরে তেমনি দূরে। অনন্তযৌবনা বাসনার বারমুডা লিলি লোভের ডগার শেষ মাথায় চিরকালই ওমনি অক্ষতসুন্দর।
..আর ডায়েরির শেষ লেখাটার পরের মন্তব্য পড়ে শিবুকাকা একটু ঘুরিয়ে প্রশংসা করেছিল। বলেছিল, ঠিকই তো বুঝেছিস দেখি, তোকে গাধার মতো গোরু কে বলে? জেনে শুনে উল্লুক হয়ে বসে থাকলে কে তোকে ঠেলে তুলবে? শিবুকাকা নাকি প্রাচীন ইতিহাস আর সংস্কৃতির স্কলার ছিল। নিজের কাগজে নিজে লেখেও ওই ছাইভস্ম নিয়েই। কিন্তু তার জিভ যখন নড়ে তখন মনে হয় সে প্রাণিবিদ্যাবিশারদ ছিল। যাক, ওই শেষে কুণাল বোস লিখেছিল তার পরের মন্তব্য পড়লে গুরু নিশ্চয় তেড়ে মারতে আসত।
–আমরা জীবন খুঁজছি। জীবনের অর্থ খুঁজছি। গুরু খুঁজছে। সঙ্গে আমিও। ভোগের তলকূল দেখতে না পেলে জীবনের কি অর্থ? ল, এথিকস, ডিসেন্সি–এসব। অসার কথার লাগাম ছিঁড়তে যদি না পারো তো ভেড়া হয়ে থাকো। ও-সব আবেগ। টাবেগের আমরা ধার ধারি না। আমাদের জীবন মানে সেনসুয়াল প্লেজার। এক ভোগ ছাই করো, অন্য ভোগের পিছনে ছোটো। থ্রিল আর উত্তেজনা জীবনের সার কথা। সেটাই জীবন। তাই মেয়েমানুষের পিছনে ছুটি, তাকে ভালবাসার ফাঁদে ফেলি, নাচি (গুরুর খরচে হোটেলের এক মেয়েমানুষের কাধ ধরে দাঁড়কাকের মতো সত্যি আমি খাসা নেচেছিলাম–উঃ, সে কি থ্রিল!) মদ খাই, ম্যারিজুয়ানা টানি। এই থ্রিল আর উত্তেজনার লোভেই শুধু একবার আমি বাবার পকেট থেকে তার মানিব্যাগটাই হাপিস করে দিয়েছিলাম। এমনি থ্রিল আর উত্তেজনার মধ্য দিয়েই আমরা জীবন খুঁজে চলেছি।