ভাবী বউদির মতো সুন্দর চেহারার মেয়ের ওপর কুণাল বোসের পুরুষের নির্মম অত্যাচার আর তাকে নিয়ে নরকে তলিয়ে যাবার প্রত্যক্ষ বর্ণনা পর্যন্ত গুরুর দারুণ ভালো লেগেছিল। বারবার বাহবা দিয়েছিল। কিন্তু তাকে নিয়ে আবার সুন্দরের অভিসারে যাত্রা-পর্ব শুনে নাক সিটকেছিল।-ও আবার কি, ক্লাইম্যাক্স থেকে অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স–কেটে দে কেটে দেযত সব সিলি ডে-ড্রিমিং!
খবরের কাগজ খুললেই রোজ কটা করে ধর্ষণের খবর। কুণাল বোস সে-সব। খুঁটিয়ে পড়ে। যে খবর যত নির্মম তার প্রতি ততো আগ্রহ। তার ভিতরে ততো উত্তেজনা। চোখের সামনে সমস্ত ব্যাপারটা কল্পনা করে ভারী আনন্দ পায়। ডায়েরিতে অকপটে সে-সব স্বীকার-উক্তি আছে। সঙ্গে মন্তব্যও–শালার খবরের কাগজগুলো ঘটা করে প্রথম পাতায় এসব খবরগুলো ছাপে কেন? পড়ে সুড়সুড়ি লাগে বলেই তো। আরো মন্তব্য, মেয়ের মতো মেয়ে হলে এ ব্যাপারটা অপছন্দ করার কথা নয়–আসলে ভয় আর লোকলজ্জা। শালার কুকুর বেড়াল গোরু ছাগলও এ-ব্যাপারে মানুষের থেকে ঢের বেশি অকপট আর সৎ।
এটা পড়েও প্রদীপ ব্যাণ্ডো খুব পিঠ চাপড়েছিল।
…রোমাঞ্চকর ডাকাতির খবর পড়তেও তেমনি ভালো লাগে কুণাল বোসের। ঘটনা যতো বড় দরের হয় উত্তেজনাও ততো বাড়ে। এ-সবেরও স্বাদ তাকে পেতে শিখিয়েছে তার গুরু প্রদীপ ব্যাণ্ডো। পয়সা খরচ করে সেক্স আর ক্রাইমের গায়ে কাটা দেওয়া বই কিনে আগে নিজে পড়ে, পরে ওকে পড়ায়। বলে, এই তো লাইফ, থ্রিল আর একসাইটমেন্ট যেখানে নেই সে আবার লাইফ। এই সেক্স আর এই ক্রাইমের ব্যাপার কলকাতায়ও এখন কম ঘটছে না। ডায়েরিতে নিজের ভাবনা লেখা শুরু করার পরে মস্ত একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়েছিল। কালো অ্যামবাসাডারে চেপে ছজন লোক এসেছিল। সতের মিনিটের আগেই সতের লক্ষ টাকা হাতিয়ে সরে পড়েছিল তারা। এই অপারেশন সারতে গিয়ে মাত্র দুজন লোক খুন হয়েছিল আর জন পাঁচেক জখম। ডাকাতদের কেউ ধরা পড়েনি।
ঘটনাটা কুণাল বোসের কাছে এত সেনশেসনাল মনে হয়েছিল যে তিনবার করে আদ্যোপান্ত খুঁটিয়ে পড়েছে খবরটা। যত ভেবেছে ততো উত্তেজনা বেড়েছে। শেষে ডায়েরি নিয়ে বসেছে।
–মনে মনে আমিও একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে উঠলাম। সঙ্গে সেই ছজনই লোক। আমি তাদের লিডার। সমস্ত প্ল্যান আমার। অপারেশন ফরমূলা আমার। প্রথমে ভেবেছিলাম পাঁচজনকে খুন করলে আর বারো চোদ্দ জনকে জখম করলেই কাজ হাসিল হবে। তাদের রক্তাক্ত মৃতদেহগুলো আমি আগেই চোখের সামনে দেখলাম। দেখলাম এই দেখাটা মন্দ উত্তেজনার ব্যাপার নয়। কিন্তু শেষে আর ওই প্ল্যান ভালো লাগল না। কারণ লোক মারা আর জখম করার উত্তেজনাটা পুরনো ব্যাপার। তার থেকে ঢের বেশি উত্তেজনার ব্যাপার কারো গায়ে একটা আঁচড় না বসিয়ে কাজ সারাটা। কাগজে এমন ডাকাতি নিয়ে দারুণ হৈ-চৈ হবে–পড়তে পড়তে সকলের বুকের তলায়। একটা ঠাণ্ডা স্রোত বইবে। হ্যাঁ, সেই প্ল্যানেই অপারেশন পাকা করলাম। এক-একজনের রিভলভারের মুখে তিনজন করে লোক পুতুল হয়ে থাকল। স্ট্রং রুমের চাবি আমার হাতে। চোদ্দ মিনিট লাগল টাকার বস্তা পিছনের গাড়ির ক্যারিয়ারে ঢোকাতে। পালাবার সময় ছটা রিভলবার থেকে মাত্র আঠারটা ফাঁকা আওয়াজের দরকার হয়েছিল।
-কিন্তু কত টাকার ডাকাতি সেটা ঠিক করতেই সময় লেগেছে একটু। প্রথমে ওই সতের লক্ষ টাকার অঙ্কটাই মাথায় ছিল। কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলাম সতের লক্ষ টাকা আর কত টাকা? ভোগের শেষ দেখতে হলে এ টাকায় আর কদিন চলবে! ডাকাতি তো আমি মাত্র একটাই করেছি বা করলাম। টাকার অঙ্কটা বাড়াতে বাড়াতে সতের লাখ থেকে সত্তর লাখে তুললাম। কিন্তু ওতেও ভোগের শেষ হয় না। ডাকাতি করে সে টাকা তো আর আমি ব্যাঙ্কে রাখতে যাচ্ছি না যে সুদের টাকায় পায়ের ওপর পা তুলে জীবন কাটিয়ে দেব? শেষে সতের কোটিতে এসে থামলাম। কোনো ব্যাঙ্কে সতের কোটি টাকা নগদ থাকে কিনা আমি জানি না। কিন্তু আমার ডাকাতি আমারই। থাকতে হবে। আমি কাগজ কলম নিয়ে হিসেব করে দেখেছি। মাসে দুলক্ষ করে খরচ করলে (দুলক্ষ কাকে বলে তা-ও আমি জানি না, কিন্তু আমার মনে হল ওতে ভোগের সমস্ত রাস্তা খুলে দেওয়া যেতে পারে।) এক কোটিতে পঞ্চাশ মাস যাব। তাহলে সতের কোটিতে আটশ পঞ্চাশ মাস অর্থাৎ সতের বছর দশ মাস চলবে। এখন আমার বয়েস একুশ (তখন একুশই ছিল), তাহলে তখন বয়েস দাঁড়াবে একানব্বই বছর দশ মাস। তার বেশি ভাবার আর কোনো মানে হয় না। ও…আপনারা ভাবছেন আমার কাঁচা হিসেব-সঙ্গী ছয় জনের ভাগ কী হবে? আসল থ্রিল তো সেইখানে। আমার অপারেশনে লোক মারা নেই, মানে ব্যাঙ্কের নিরীহ লোকগুলোকে মারা নেই। তা বলে শত্রু মারব না এমন হলপ কে করেছে? ডাকাতির রাতে খেয়ে দেয়ে ফুর্তি করে ঘুমিয়ে আমার সঙ্গীরা কি আর দিনের মুখ দেখেছে? কাজটা কত সহজ। মদ খেয়ে সকলের তখন টইটম্বুর অবস্থা। সেই অবস্থায় আমি নিজের হাতে প্রত্যেকের ড্রিংক সাজিয়ে হাঁক দিলাম, লাস্ট ড্রিংক ফর দি বেড়। হ্যাঁ, ডাকাতির পর কুচকুচে কালো অ্যাম্বাসাডারের বদলে ধপধপে সাদা অ্যামবাসাডার চেপে আমরা দেড়শ মাইল দুরের এক হোটেলে উঠেছিলাম। একসঙ্গে নয়। আলাদা আলাদা। একে একে। কেউ কাউকে চিনি না। একেবারে শেষে সাদা অ্যামবাসাডার হাঁকিয়ে এসেছি একলা আমি। তখন রাত। অন্য ছজন যে যার ঘরে। আমার গাড়ির পিছনের ক্যারিয়ারে সতের কোটি টাকা কে আর জানছে। (ক্যারিয়ারে সতের কোটি টাকা আবার ধরে তো?) যাক সঙ্গীরাও জানে না, আমি শুধু রাতটুকুর জন্যেই আগাম টাকা দিয়ে ঘর বুক করেছি–ভোর রাতে উঠে গাড়ি নিয়ে চলে যাবার কথাও বুকিং ক্লার্ককে বলে রেখেছি। যাক, মনের আনন্দে আমার ঘরের রাতের আসর শেষে আমার অর্থাৎ লিডারের হাত থেকে সঙ্গীরা লাস্ট ড্রিংক ফর দি বেড় নিল। প্রত্যেকের গেলাসে (নিজের বাদে) সেই লাস্ট ড্রিংকে আমি কখন কি মিশিয়েছি সজাগ সচেতন থাকলেও তারা টের পেত না। তখন তো নেশায় বুদ। কি মিশিয়েছি সেটা অবশ্য আমি নিজেও এই লেখার সময় পর্যন্ত জানি না। এমন কিছু যা মদের গেলাস শেষ হবার পরেও ওরা যে যার। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়া পর্যন্ত কোনো কাজ করবে না। তারপরই ওই ড্রিংক লাস্ট ড্রিংকই হবে। আর উঠবে না। আর এই না ওঠাটা যখন জানাজানি হবে তখন আমি কোথায় আর আমাকে সন্দেহই বা করে কে?