বিকেলে আধঘণ্টা আগেই মেট্রোর সামনে অপেক্ষা করছিল, আর সব থেকে শস্তার সব চেয়ে কড়া সিগারেট টেনে সময় পার করছিল। ঠিক সময় ধরেই ব্যাণ্ডেদা আর সেই মেয়ে হাত ধরাধরি করে হাজির। ও সামনে আসতে ব্যাণ্ডোদা (কুণাল অনেক সময় গুরু ছেড়ে ব্যাণ্ডোদা বলে কারণ এই ডাকের মধ্যে একটা নতুনের চমক আছে। –অন্তত তখন ছিল) পরিচয় করিয়ে দিল। বলল, এই আমার সেই কচি-কাঁচা লাজুক শিষ্য কুণাল বোস–তুমি আসছ তাই লাজুক তো আসতেই চায় না! সঙ্গে সঙ্গে এক চোখ একটু ছোট করে মেয়েটাকে গুরু একটু ইশারাও করল। ভব্যতার খাতিরে সেই মেয়ে কুণালের দিকে ফিরে একটু মাথা নাড়ল, আর ঠোঁটের কোণে হাসল, আর চোখের কোণে ভালো করে দেখে নিল। গুরুর কি কারসাজি ঠাওর করতে না পারার ফলে কুণাল মুখে একটু লাজুক-লাজুক ভাব টানাই বুদ্ধিমানের কাজ ভাবল।
কিন্তু বুকের ভিতরটা সত্যিই তখন একটা বাস্তব থ্রিলের তৃষ্ণায় ধকধক করছিল। এই মেয়ের উঁচু বুক আর টসটসে ঠোঁট দুটো শুকনো ডায়রি নয়–তার থেকে দের ঢের নরম-গরম বাস্তব।
একেবারে সারির শেষের তিনটে সীটে তারা তিনজন। প্রথমে গুরু মাঝে মেয়েটা শেষে কুণাল। কুণালের পরে সেই রো-তে আর সিট নেই। আলো নিভল। ছবি শুরু হল। মেয়ে পুরুষের মাখামাখি লপটা-লপটির হিন্দী ছবি। শুরু থেকে ঢলাঢলি। কিন্তু ছবি দেখবে কি, খানিক বাদেই কুণালের সর্বাঙ্গে কাটা। মেয়েটার হাঁটু আর হাঁটুর ওপরের খানিকটা কুণালের একদিকের সঙ্গে ক্রমে সেঁটে যেতে লাগল। আর কাঁধের ওপরের দিকটা ওর কাঁধের সঙ্গে একটা চাপাচাপির খেলা শুরু করে দিল। মাঝে মাঝে অন্ধকারেই আবার ঘুরে তাকায়। কুণালের গালে গরম নিঃশ্বাসের ছেকা লাগে।
হাফটাইমের আলো জ্বলতেই মেয়ে আবার শান্তশিষ্ট। মাঝে ভব্যরকমের ফারাক। এক একবার গুরুর কানে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলছে কিছু আর কুঁই কুঁই করে হাসছে। গুরুর তাকানো দেখে মনে হয় মজাটা ওকে অর্থাৎ কুণালকে নিয়েই। রোগাপটকা কুণালের ভিতরে যে তখন মদমত্ত দামাল হাতি দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে। সে যদি ওই মেয়ে জানত।
আবার ছবি শুরু হতে একই কাণ্ড শুরু হল। কুণালের শরীরের কণায় কণায় এবারে ডবল সাড়া দেবার ইচ্ছে। কিন্তু ও বুঝে নিয়েছে তাহলে মজা মাটি-ওকে লাজুক ছেলের ভূমিকা নিতে হবে। খানিক এ-রকম চলার পর মেয়েটার একটা আলতো হাত ওর হাতের ওপর এসে পড়ল। পড়ার পর পড়েই থাকল। তারপর উঠল যখন। কুণালের হাতখানা সুদ্ধ নিয়ে উঠল। ওর হাতটা গরম হাতে ধরে চেয়ারের হাতলের তলা দিয়ে টেনে নিজের কোলের ওপর ফেলল। তারপরে ওই হাত কোলের ওপর রেখে আর গরম হাতের আঙুলে আঙুলে খেলা চলল।
ছবি শেষ হবার পর বাইরে বেরিয়ে ঠোঁটের কোণে তেমনি হেসে আর চোখের কোণে তেমনি করে চেয়ে মেয়েটা জিজ্ঞাসা করেছিল, ছবি কেমন লাগল কুণাল বাবু?
নিরীহ লাজুক মুখ করে কুণাল জবাব দিয়েছে, ছবি আর দেখতে দিলেন কই।
চারুমুখির দুচোখ কপালে। আমি আবার কি করলাম।
গুরু হেসে উঠেছিল। বলেছিল, সম্পর্কটা যখন বউদি হতে চলেছে মওকা পেয়ে তুমিও একটু বাড়লে খুব অন্যায় হত না হাঁদা কোথাকারের।
ওকে বিদায় দিয়ে তারা পার্ক স্ট্রীটের দিকে চলে গেছল। আর কুণাল সর্বাঙ্গে জ্বলুনি নিয়ে ঘরে ফিরেছে। পরে গুরুর মুখে শুনেছে, মেয়েটাকে বলে রেখেছিল, শিষ্য–তার দারুণ লাজুক আর দারুণ ভালো ছেলে, সিনেমা হলে বসে ওর যদি ঘাম ছুটিয়ে দিতে না পারো তাহলে মজাই মাটি।
হেসে হেসে গুরু জিজ্ঞেস করেছিল, তা তোর ওটুকু বাস্তব অভিজ্ঞতা কেমন। লাগল বল।
কুণাল গলা শুকিয়ে জবাব দিয়েছে, তুমি শালা এক নম্বরের শত্রু গুরু বুকের মধ্যে এখন সাহারা জ্বলছে–ফের পেলে ওই ভাবী বউদিকে আমি না খুন করে বসে। থাকি।
ওই ভাবী বউদিটিই ছমাস বাদে গুরুর বিরুদ্ধে কোর্টে কেস ঠুকে দিয়েছিল। গুরু নাকি তাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার সঙ্গে মেলামেশা করত। শেষে। একদিন তার সর্বনাশ করে সরে পড়েছে। মেডিক্যাল চেকআপে পর্যন্ত সর্বনাশ প্রমাণ হয়েছিল। কিন্তু সর্বনাশটা শেষ পর্যন্ত কার মারফৎ হয়েছে সেটা প্রমাণ হয়নি। কারণ জেরায় জেরায় সাবালিকা মেয়ের অনেক গলদ বেরিয়ে পড়েছে।
যাক, এই সুন্দর ডায়েরিটার পাতা একটা দুটো করে ভরাটি হতে শুরু করেছে। আরো সাত আট মাস পর থেকে। হঠাৎই খেয়ালের বশে ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল। তারপর শুরুর তারিফ পেয়ে উৎসাহ বেড়েছিল। ব্যাপার আর কিছু না, ভিতরে কোনো বাসনা যখন দুর্বার হয়ে ওঠে, কোনো ঘটনায় স্নায়ুগুলো যখন উথাল পাথাল করতে থাকে–তখন ডায়েরির পাতায় সে-সব লেখা। লিখে ফেলে তার ওপরে কিছু মন্তব্য করা।
যেমন প্রথমেই লিখেছিল, এই ডায়েরি যার কাছ থেকে পাওয়া সেই ভাবী বউদির। মতো একটি মেয়েকে সমস্ত নিষেধের গণ্ডী থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারলে কুণাল বোস কি করে? ওই ভাবী বউদির মতো স্বভাব চরিত্রের মেয়ে নয়, শুধু তার মতো অমন টসটসে দেখতে–কিন্তু তার ভেতরখানা তখন পর্যন্ত কোন সভ্যভব্য সুপুরুষকে নিয়ে কল্পনার জাল বুনছে। অবাধ্যতার জন্য তার ওপর প্রথমে কি ভাবে নির্মম আঘাত করে তাকে বোবা বানিয়ে দিত আগে তাই লিখেছে। কিন্তু বোবা বাধ্য মেয়ে কোন ছেলে চায়? সেই আক্রোশে তাকে কতভাবে নরকের তলায় টেনে নিয়ে চলেছে তার হুবহু বর্ণনা। কিন্তু মেয়েটা যখন শেষে আর বোঝে না, তাকেই যখন নরকের দোসরে। মেনে নিয়েছে, আত্মহুতি সম্পূর্ণ ভাবছে, তখন আবার কুণাল বোস নতুন চমক সৃষ্টিতে মেতে উঠেছে। যে সুন্দরের স্বপ্ন দেখত মেয়েটা, যে স্বপ্নের জাল বুনত, নরক ছেড়ে তাকে নিয়ে সেই দিকে এগিয়েছে। সেই সুন্দরের দরজা তারই বুকের তলায়–একটু একটু করে এবারে সেই দরজা খুলে দিয়েছে। তার সেই স্বপ্নের জালে এসে নিজেই ধরা দিয়েছে। মেয়েটা হতভম্ব হয়ে দেখছে, যার একদিক এমন কুৎসিত নরক, তারই আর একদিক কি অনির্বচনীয় সুন্দর! লেখার শেষে মন্তব্য, আমি কুৎসিত আমিই, সুন্দর আমার একটাকে যে নেবে সে আধখানা নেবে। আমার শালা একটাতে ক্লান্তি ধরে যায় বলে আমি ভোগে কখনো সুন্দর কখনো কুৎসিত।