গুরু মানে প্রদীপ ব্যাণ্ডোর বয়স এখন সাতাশ। কুণালের থেকে চার বছরের বড়। নিউইয়র্ক ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিল তেরো বছর বয়েসে। কুণালের পনের বছর বয়েস থেকে সে এই গুরুর চেলা। এদিক থেকে গুরু উদার বলতে হবে। সে বয়েস দেখে না, বশ্যতা দেখে। হুকুম তামিল করার কেরামতি দেখে। সেই পনের বছর বয়েস থেকে এ এলাকার এমন কি পাড়ার কত মেয়ের কাছে গুরুর চিঠি চালান করেছে, জবাব নিয়ে এসেছে-সন্ধ্যার পর লেকে দূরে দাঁড়িয়ে তাদের পাহারা দিয়েছে, ঠিক আছে? আদর করে কুণাল মাঝে মাঝে শালা গুরু তুমি বলে কথা ঝাড়ে তাতেও গুরু হাসে। আনন্দে পিঠ চাপড়ায়। গুরুর নিজস্ব একটা ছোট্ট গাড়ি ছিল আরো ছবছর আগে পর্যন্ত। গুরুই চালাতো। তার পাশে কোনো না কোনো চটকদার মেয়ে থাকতই। আর পিছনে থাকত কুণাল। শুধু কি বাঙালী মেয়ে? বড় বড় রেস্তেরাঁ বা তার পাশের রাস্তা থেকে অবাঙালী মেয়ে গাড়িতে তোলার ব্যাপারেও গুরু কি কম ওস্তাদ ছিল! চোখাচোখি হলেই বুঝতে পারত কে উঠবে আর কে উঠবে না।
ওই রকম মেয়ের পাল্লায় পড়ে আর নেশার রসদ জোগানোর তাগিদে গাড়িটা জলের দরে বেচে দিয়েছিল। গুরুর নেশা তো আর মদ বা বিড়ি সিগারেট নয়। সে তখন থেকেই হাসিস আর মারিজুয়ানার খদ্দের। বাবা আবার একটা গাড়ি কিনে দেবে ধরেই নিয়েছিল। কিন্তু আজও দিল না। গুরু এ জন্যে যে ভাষায় নিজের বাবা-মাকে গালাগালি করে শুনে কুণাল মুগ্ধ।
গুরুর সব থেকে বড় পাসপোর্ট তার চেহারা। এখনো। কোনো ছেলে যদি মাখনের দলা হয় অনেক ডাঁশা মেয়ে তাকে পাত্তা দেয় না। কিন্তু সেই মাখনের দলা যদি স্মার্ট হয়, একসঙ্গে চোখ আর ঠোঁটে হাসতে জানে, তার কথার থেকে কাজের হাত যদি বেশি এগোয়–তাহলে কিস্তি মাত। গুরুর এই সাতাশ বছর বয়সে এমন কিস্তি মাত কম দেখল না কুণাল বোস। ভালো ঘরের কলেজে পড়া একে একে দুদুটো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেখল আর ডিভোর্স দেখল। কোর্টে এ পর্যন্ত তিন তিনটে মেয়ে ফুসলে নিয়ে পালানোর কেস দেখল, কি সেনসেশন, কি উত্তেজনা কুণালেরই তখন। যে উত্তেজনার নাম জীবন, গুরু হাতে-নাতে ওকে তাই দেখিয়েছে। পাড়ার কোনো। মেয়ে এখন- গুরুর দিকে তাকালে পর্যন্ত বাপ-মা মেয়েকে শাসন করে। কিন্তু তবু গুরুকে ঠেকায় কে? তার লীলা কি শুধু এই পাড়াটুকুর মধ্যে?
গুরুর মধ্যে অভিজ্ঞতার বীজ বোনা হয়েছে কি আজকে? বীজ বোনা হয়েছে। সেই তের বছর বয়সে–নিউ ইয়র্কে। একটু ভালো করে বোঝার আগে বাবা মা যে তাকে কি আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছে, মনে হলে তাদের খুন করতে সাধ যায়। ছেলের। এই কলকাতা শহরে কত লোক অসময়ে পটাপট মরছে–আর তার বাবা মা যেন একটা বেঁচে থাকার খুঁটি ধরে বসে আছে। সম্ভব হলে, নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে আসার জন্যেই বাবা মাকে সে চরম শাস্তি দিত। আর, সেখানকার মেয়েগুলো কি মেয়ে? জলজ্যান্ত আপেল এক একখানা। ফাঁক পেলে পনের ষোল সতের বছরের সেই মেয়েগুলো ওকে বুকে জাপটে তুলে নিয়ে পালানোর জায়গা খুঁজত। চুমু খেয়ে খেয়ে গালে ঠোঁটে জ্বালা ধরিয়ে দিত–ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে গিয়ে। ওকে বুকের ওপরে চেপে ধরে শুয়ে থাকত-আরো কত কাণ্ডমাণ্ড করত শুনলে তোর নোলা দিয়ে জল গড়াবে।
জল যেটুকু শুনতো তাতেই গড়াতে কুণালের।
হ্যাঁ….এই ডায়েরিটার কথা। তিন বছর আগে টেবিলের ওপর গুরু ওটা ছুঁড়ে দিতেই বুকের ভিতরটা চড়চড় করে উঠেছিল কুণালের। ওর ততক্ষণে কেমন যেন বদ্ধ ধারণা, দেবার আগে ওই কালো ডায়েরির চকচকে বোর্ডে অন্তত গণ্ডা আষ্টেক চুমু খেয়েছে মেয়েটা। সেই তাপ ওতে এখনো লেগে আছে। তখুনি বলে বসেছিল, গুরু এই ডায়েরিটা আমাকে দেবে?
-ওটা দিয়ে তুই কি করবি?
কি বললে গুরু খুশি হবে আর উদার হবে কুণালের ততদিনে ভালোই জানা। জবাব দিয়েছিল, মাঝে মাঝে বুকের ওপর রাখব আর চুমু খাব। আমি আর এর থেকে বেশি কি পাব বলো।
শুনে গুরু হেসে সারা। হাসি আর থামতেই চায় না। শেষে বলেছে, আমার শিষ্য হয়ে তোর এ-রকম আনপ্র্যাকটিক্যাল সেলফ-স্যাটিসফ্যাকশন–আঁ? আরে কল্পনার ভোগ তো কবিদের জন্য আর স্পাইনলেস ছেলেদের জন্য! আমার শিষ্য হবে মোস্ট রেকলেস প্র্যাকটিক্যাল–সাধ গেলে হাতে হাতে আদায়। এই যে ডায়েরি দিয়ে গেল এর ওপরে আমি বিরক্ত কেন? সাধ আছে, সাহস নেই। আরে বাপু রেখে। ঢেকে সব দিক বজায় রেখে কতটুকু পাবে–ভিতরে বান যখন ডেকেছে সব দিক তছনছ করে দিয়ে ছোটো না, তবে তো থ্রিল–তবে তো একসাইটমেন্ট তবে তো লাইফ। ডায়েরিটা তারপর ওর দিকে ঠেলে দিয়েছিল, যা নিয়ে যা, দুধের সাধ ঘোলে মেটা।
তার পরেই মাথায় একটা উদার প্ল্যান এসে গেছল। তোকেও ছিটেফোঁটা প্র্যাকটিক্যাল আনন্দ দেবার ব্যবস্থা করছি। তোর জন্যে একটা টিকিট কেটে রাখব .আর মেয়েটাকে যা বলার বলে রাখব। ছটায় শো, তুই ঠিক সময়ে মেট্রোয় থাকিস।
তিন বছর আগে এই ডায়েরি হাতে করে বাতাস সাঁতরে নিজের ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে ছিল। ব্যাণ্ডোদা যতই মুখ বাঁকাক আর ছেলেমানুষ ভাবুক ওকে, এটুকুতেই যে এত থ্রিল এত উত্তেজনা এ কি ভেবেছিল! বয়েস তো সবে তখন। কুড়ি। বি, এ ফেল করে আর পড়া ছেড়ে সবে গুরুর যোগ্য শিষ্য হয়েছে। তার আগে যেটুকু উত্তেজনার দিন গেছে তার বেশির ভাগ কাল্পনিক। গুরুর চেলাগরি করে। আর তার ভোগ কল্পনা করে যেটুকু আনন্দ। কিন্তু এই ডায়েরিটা বা ডায়েরিতে মেয়েটার স্পর্শ তো আর কল্পনা নয়। ফেরার আগে ওই মেয়ে যে ডায়েরির মলাটে গণ্ডাকতক চুমু খেয়ে নিয়েছে তা-ও কল্পনা বলে স্বীকার করতে রাজি নয় কুণাল। ঘরে এসে ওই ডায়েরির মলাটে গাদা গাদা চুমু খেয়ে বার বার ওটা বুকে চেপে ধরে বেশ একটু নতুন থ্রিল আর উত্তেজনা উপভোগ করেছে। কিন্তু সিনেমা হলে আরো থ্রিল ওর জন্যে অপেক্ষা করছে সেটা ভাবতে গিয়েই শিরায় শিরায় রক্ত গরম। ওর জন্যেও ব্যাণ্ডোদা টিকিট তো কেটে রাখবে, কিন্তু মেয়েটাকে আবার কি বলে রাখবে? মেয়ের পাশে বসে ছবি যে দেখেনি এমন নয়। আর তখন খুব সংগোপনে আর অন্যমনস্কর মতো এক একবার হাত ঠেকিয়েছে, হাঁটুতে হাঁটু লাগিয়েছে–তক্ষুণি আবার অপ্রস্তুত ভদ্রলোকের মতো গুটিয়ে বসেছে। একবার তো চিত্তির। বার কয়েক ও রকম করার পর হাফটাইমের আলো জ্বলতে দেখে মায়ের বয়সী একজন।