সামনের রমণীমুখ ভালো করে তেতে ওঠার আগেই কুণাল বোস লম্বা পা ফেলে তার দুহাতের মধ্যে এসে দাঁড়ালো। নিজের চেষ্টায় গড়া চেহারার ছাঁদ ছিরি যেমনই হোক, গলার স্বর যে এই মূর্তির সঙ্গে বেখাপ্পা রকমের মিষ্টি আর নরম তা-ও জানে। নিঃসংকোচে পিছনের দরজাটা আঙুল দেখিয়ে বললে, উনি এখন একা আছেন, আপনি যেতে পারেন।
বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় মেয়েটি নড়ে চড়ে ওঠার আগেই কুণাল বোস ঘরের বাইরে। সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়ে আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ালো। এখান থেকেও সামনের দরজা দিয়ে সোজা শিবু কাকার পার্টিশন ঘেরা পর্যন্ত চোখ চলে। মেয়েটি ললিত ছন্দে ওই ঘরের দরজা পর্যন্ত পৌঁছেছে। মেয়েদের সামনে থেকে দেখতে বেশি ভালো লাগে কি পিছন থেকে কুণাল বোস ঠিক হদিস পায় না। অনেক সময় খেয়াল করে দেখেছে, যে মেয়েদের সামনে থেকে ভালো লাগে পিছন থেকে তাদের বেশির ভাগই যেন আরো ভালো লাগে। কিন্তু সামনে থেকে দেখতে যাদের হত-কুচ্ছিত লাগে তাদেরও এক একজনকে পিছন থেকে দেখতে অদ্ভুত ভালো। এমন একটা অভিজ্ঞতার কথা হাতের এই ডায়েরিটাতেই লেখা আছে।…আজ এক শ্যামাঙ্গী দীর্ঘাঙ্গীকে দেখলাম বিশ গজ আগে আগে হাঁটছে। দেখার সঙ্গে সঙ্গে সেই সুঠাম রমণীঅঙ্গ ঘিরে আমার গর্তে ঢোকা আদেখলে চোখ দুটো বনবন করে চক্কর খেতে লাগল। পা চালিয়ে ফারাক যত কমিয়ে আনছি, ভিতরের পশুটা ততো থাবা খুলছে। চলার ঠমকে সর্বাঙ্গের জোয়ার ঢেউ খেলে খেলে রেখায় রেখায় তটে তটে পা বেয়ে নেমে আসছে। গা ঘেঁষে তিন পা এগিয়ে গেলাম, ঘুরে তাকালাম। কি কুচ্ছিত কি কুচ্ছিত। কেউ যেন আমার গালে কষে একখানা থাপ্পড় বসিয়ে সব কিছুর ছন্দপতন ঘটিয়ে দিল। তারপর আবার আমি পিছনে। সে সামনে।…দেখে দেখে আমার মনে হচ্ছিল দ্বাপরের মানুষগুলো অনেক অকপট ছিল। যুধিষ্ঠিরকে পর্যন্ত দ্রৌপদীকে কয়েক জায়গায় অয়ি নিতম্বিনী বলে সম্বোধন করতে দেখা গেছে। কিন্তু এ-কালের দ্রৌপদীরা ওই বচন শুনলে সোজা একখানা চড় বসিয়ে দেবে
লেখার সময় সেই বাস্তব অনুভূতিটা এমনি প্রত্যক্ষ সত্য হয়ে উঠেছিল, যে হাতের ডায়েরি না খুলেও মুখস্তর মতো বলে যেতে পারে। দ্বিধান্বিতচরণ মেয়েটিকে শিবুকাকার দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে যেতে দেখা গেল। মনে হয় কোনো লেখা-টেখার তদবির তদারকে আসা। শিবুকাকা ঘরে একা। তার দুর্ভাগ্য কি সৌভাগ্য কে জানে। বোধহয় দুইই। শিবুকাকার বয়স ষাট, সেইজন্য সুবিধে। সুবিধে ক্যাশ করার। বয়েস কিন্তু গতর যখন নেই দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি?
সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায়। দোকানের ঘড়িতে বিকেল প্রায় চারটে। এক দেড় ঘণ্টা সময় খামোখা নষ্ট। একেবারে নষ্টই বা বলে কি করে। হাতের এই গাবদা ডায়েরিটা তো উদ্ধার হল। এটা এ বছরের নয়। তিন বছর আগের। কোনো মেয়ে গুরুকে প্রেজেন্ট করেছিল। গুরু বলতে প্রদীপ ব্যাণ্ডো। ডায়েরিটাতে কালোর চেকনাই ঠিকরে পড়ছিল। তার ওপর জ্বলজ্বল করছিল বড় বড় হরফের সোনালি ছাপ। ভিতরে সিল্কের ফিতে। ডায়েরি রসিকদের পছন্দ হবার কথা। কিন্তু কুণাল তখন পর্যন্ত একটুও ডায়েরি রসিক নয়। ওই কলেজে পড়া মেয়েই বা অমন ডায়েরি কোথায় পাবে! বাপ কাকা দাদা কারো কাছ থেকে হাতড়েছে। তারপর যে মুখ করে গুরুকে ওটা প্রেজেন্ট করেছিল, কুণালের মনে হয়েছিল মেয়েটা তার সর্বস্ব ওই হাতে দিয়ে দিলে, ছটার শোয়ে সিনেমা দেখার প্রোগ্রাম পাকা করে মেয়েটা চলে যেতেই গুরু তাচ্ছিল্য ভরে ডায়েরিটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছিল, সুন্দর মুখে বিরক্তির হিজিবিজি দাগ ফেলে বলেছিল, ভাল্লাগে না এ-দেশের মেয়েগুলো সব ভীতুর হদ্দ। অন্ধকারে বসে গা। টেপাটেপি করতে দেবে, সিনেমার পর ভালো রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলে আর আলাদা ক্যাবিনে নিয়ে ঢোকাতে পারলে বড় জোর একটু জাপটে ধরতে দেবে আর দুটো চুমু খেতে দেবে–তার বেশি এগোতে যাও অমনি হৃৎকম্প। আর নিউইয়র্কের মেয়েগুলো? শালা বারো বছর বয়সে ছেলেগুলোকে কাঁচপোকার মত হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায়–নিজেরা যেমন লোটে তেমনি লুঠতেও দেয়।
গুরুর মুখে নিউইয়র্কের গল্প শুনে শুনে কুণালের দুকান হেজে পচে যাবার কথা। কিন্তু উল্টে যেন মজা নদীতে রসের বান ডাকে। আগে তো শুনেই ওর কান গরম হত, সমস্ত শরীর গরম হত। শুনে শুনে গুরুর নিউইয়র্ক কুণালের কাছেও স্বর্গ। উত্তেজনার এমন জায়গা পৃথিবীতে আর কোথাও আছে নাকি? সেখানে উত্তেজনারই অন্য নাম জীবন। সেই জীবনের স্বাদ ভালো করে পাবার আগেই গুরুকে চলে আসতে হয়েছে এই খেদ তার যাবার নয়। গুরুর বাপ ছিল সেখানকার ডাক্তার। সেখানে এক একজন ডাক্তার–মানে কি? আইনের জাল-ছেঁড়া ডাকাত। দুবেলা দুপকেট বোঝাই করে ডলার আনত। সে কি রাজার হালে থাকা। তিন তিনটে গাডি ছিল ওদের। একটা বাবার, একটা মায়ের, আর একটা ওদের তিন ভাইয়ের। বাবার গাড়ি বাবা, মায়ের গাড়ি মা চালাতো। আর ওদের তিন ভাইয়ের গাড়ি সফার চালাতো। সেখানে একজন সফারের মাইনে কি তোর ধারণা আছে? এখানকার মাসের দশ হাজারিরাও সেই মাইনের ড্রাইভার রুখতে হলে ফতুর হয়ে যাবে।
ওর সেই ডাক্তার বাবার আর ভোদা মায়ের কি মতি হল–বাড়ি ঘর বেচে দিয়ে কয়েক আঁক-বোঝাই টাকা নিয়ে দেশে চলে এলো। ঢের সুখ করা গেছে এখন। ছেলেদের জন্যেই নাকি তাদের চাটি-রাটি তুলে চলে আসা। রাগে মুখ লাল করে গুরু বলত, অনেক সুখ তোমরা করলে, আমাদের কি হল? ছেলে মেয়ের সুখের এমন বারোটা যে বাজায় তারা বাবা-মা না শত্রু! এখানে তারা এসে বিরাট বাড়ি হাঁকিয়ে, দাসদাসী বাবুর্চি খানসামা রেখে দিব্যি পায়ের ওপর পা তুলে দিন কাটাচ্ছে। বাবার প্র্যাকটিসও এখানে নামেই, বিকেলে দুঘণ্টার জন্য চেম্বারে যায়–সন্ধ্যায় মায়ের সঙ্গে হুইস্কি গেলে। আমাদের জন্য আসা, আমরাই বা কি দিগগজ হলাম। আমাকে তো অন্তত বি, এ-টাও পাশ করাতে পারলে না। ভাই দুটো যা-হোক মেজে-ঘষে গ্র্যাজুয়েট হয়েছে।