দু-চার মুহূর্তের নিঃশব্দ দৃষ্টি বিনিময়।
অমর দত্তর ঠোঁট দুটো আর একবার থর-থর করে কেঁপে উঠল শেষ বারের মত। তার পর এক বিস্মৃতিদায়িনী, স্পর্শের মধ্যে নিবিড় করে আশ্রয় পেল তারা। এত কালের হাড় কাঁপানো হিমশীতল অনুভূতিটা যেন নিঃশেষে মিলিয়ে যাচ্ছে। উষ্ণ। …নরম।…তন্দ্রার মত।…ঘুমের মত।…ঘুমিয়েই পড়ল।
পরের কটা দিনের তুচ্ছতা বাদ দেওয়া যাক। নির্দেশ মত তাকে নিয়ে বাইরে। বেড়ানো, সিনেমা দেখা, থিয়েটার দেখা।
রেখা তাগিদ দিল কর্ণেলকে, এর পরে মুশকিলে পড়ব, তাড়ান শীগগির।
কর্ণেল হাসেন, ইউ প্রেটি উইচ।
রেখা প্রতিবাদ করে, ফিনিল্ড এ্যাকট্রেস।
এর পর কদিন ধরে কর্ণেলের ঘরে বসে নিজের রোগজীর্ণ প্রতিচ্ছবিটি দেখেছে অমর দত্ত। বৈজ্ঞানিক রেকর্ডে নিজেরই দুই একটা পাগলামীর নমুনা শুনে শিউরে উঠেছে। আগের দুজন রোগীকে কি করে ভালো করেছে রেখা মিত্র তাও শুনল। সব শেষে, একই উপায়ে নিজের আরোগ্য লাভের ইতিবৃত্ত। নিপুণ মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ এবং সারগর্ভ উপদেশ শিরোধার্য করে গৃহপ্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ করল যখন, তখন মনটাই শুধু ভারাক্রান্ত হয়ে আছে ক্লান্তিকর বোঝার মত। এ ছাড়া আর কোন উপসর্গ নেই।
রেখার প্রতীক্ষা করছিল। সে এলো।
–যাবার সময় হলো, এই জন্যেই ডেকেছিলাম।…আপনাকে চিরকাল মনে থাকবে আমার।
সমরেশ চক্রবর্তী বলেছিল। মাধব সোমও বলেছিল। রেখা হাসল।–সেটা কি খুব ভালো কথা হবে?
দুই-একটা মৌন মুহূর্ত। অমর দত্ত হাত তুলে নমস্কার জানালো, আচ্ছা, চলি।
হাত তুলে প্রতি নমস্কার করল, রেখাও, হ্যাঁ, আসুন।
অমর দত্তর কাহিনী শেষ হয়েছে। কিন্তু এ কাহিনী অমর দত্তর নয়। রেখা মিত্রর। অনেক, অনেক দেরীতে জেনেছে বীণা সরকার, রেখা মিত্রর রোগী ভালো করবার রহস্যটুকু কি! অনেক, অনেক দেরীতে জেনেছেন মনোবিজ্ঞানী কর্ণেল পাকড়াশী, কোন নির্দেশই তার মেনে চলেনি রেখা মিত্র। অনেক, অনেক দেরীতে জেনেছে বাকি সকলে, রেখা মিত্র রোগী ভাল করেছে, ফাঁকি দিয়ে নয়, ভালবাসার অভিনয় করে নয়, সত্যিকারের ভালবেসে। পর-পর তিন জনকেই।
হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা আর একজন বেড়েছে। রোগী নয়, রোগিণী। সে রেখা মিত্র।
বারমুডা লিলি
কুণাল বোস হেসেই বাঁচে না। শিবু কাকার দপ্তরে বসেও হেসেছিল। তাই দেখে শিবু কাকা ধমকেই উঠেছিল। বলেছিল, আমি কি তোকে তোয়াজ তোষামোদ করে চলার পাত্র, যে মিথ্যে তোকে বাড়াতে যাব? না কি আমার কাগজটা আঁস্তাকুড় একটা যে। ছাই-ভস্ম যা পাব তাই নিয়ে ছাপার জন্য হাঁ করে থাকব? এত কাল কাগজ চালাচ্ছি, এত লেখা লিখছি কলমের আঁচড় টানা দেখলে কার মধ্যে কি আছে বুঝতে পারি না–আঁচ করতে পারি না? যে লেখা দেখে তোর বাবা অমন আগুন হয়েছে, তোকে কেটে দুখানা করতে পারলে শান্তি হয় বলেছে, আর তারপর মাথার বিকৃতি কি না দেখার জন্য অত চুপিচুপি ডায়েরিটা আমার কাছে চালান করেছে–সেই সব ছাইভস্ম লেখার মধ্যেও একটা সম্ভাবনা দেখেই তোকে আমার কাছে পাঠাতে বলেছিলাম নইলে আমার সময় কি কুল গাছ যে তোদের মতো অকাল কুণ্ড এসে ঝাঁকালেও ঝরঝর করে পড়বে? বাঁদর কোথাকারের।
নিচের কুচকুচে কালো ঠোঁটটা ছাতলা পড়া দাঁতে ঘষে কুণাল সবিনয়ে আপত্তি জানিয়েছে, ওই জীবটার অসম্মান কেন করছেন শিবু কাকা–বরং বাঁদরের কোথাকার বলুন।
শিবুকাকা আবার রেগে উঠতে গিয়ে হেসে ফেলেছিল। (কি বললি? বাঁদরের থেকে ইতর বাঁদরেতর) হাঃ হাঃ হাঃ–ওই জন্যই তো বলছিলাম আদা। জল খেয়ে লেগে যদি যাস তোর হবে। হলে দুটো পয়সারও মুখ দেখতে পাবি বাপ-দাদার হোটেলে খাচ্ছিস বলে দিন-রাত অত লাথি গুতোও খেতে হবে না। তা বলে ছাই ভস্ম যা হোক লিখে আনলেই তো আর আমি ছাপব না–সে রকম কিছু থাকলে তবে কথা। সেটা এমনি হয় না, বাঁদরামি ছেড়ে, মানে বাঁদরেতরামি ছেড়ে অনেক কাঠ-খড় পোড়ালে তবে হয়। কালো লম্বাটে বাঁধানো ডায়েরি বইটা শিবুকাকা তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে। যা এখন, অনেক সময় ঢেলেছি তোর জন্যে, আর না।
ওটা হাতে করে কুণাল শিবুকাকার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। ঝোলানো গোঁফ আর থুতনির নিচের অল্প দাড়ির গোছায় মুখের হাসি ছড়িয়ে পড়ছে। তারপরেই গর্তের প্রায় গোল চোখ দুটো সচকিত। শিবুকাকার ঘরের পার্টিশনের এ ধারে একজন সাব এডিটর আর দুজন প্রফরিডার মাথা গুঁজে কাজ করছে। তাদের থেকে একটু দূরের চেয়ারে বেশ সুশ্রী একটি মেয়ে বসে আছে। বয়সে কুণালের থেকে বছর দুই তিন বড়ই হতে পারে…বছর পঁচিশ ছাব্বিশের কম নয়। কপাল ফাঁকা, সিঁথিতে সরু একটু নিদূরের দাগ ঝিলিক দিচ্ছে। কুণাল শিবুকাকার পার্টিশন দরজার ওপার থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে আসতেই চোখাচোখি। ও ঘরে ছিল বলেই মেয়েটিকে এদিকের এরা বসিয়ে রেখেছে মনে হয়। কুণালের লুব্ধ দুচোখ কয়েক নিমেষের মধ্যে নারীদেহ। ছিঁড়ে খুঁড়ে আবার মুখের ওপর এসে স্থির হল। এই চাউনি পড়ে নিতে বা বুঝে নিতে কোনো মেয়েরই ভুল হয় না বা সময় লাগে না। তখন কত রকম দেখতে হয়। সুন্দর মুখে বিরক্তির আঁচড় পড়ে। ধারালো হয়, ঘোরালো হয়, চোখে আগুনও ছোটে। কুণালের তখন আরও মজা লাগে। মনে হয় ও যেন চোখ থেকেই দুটো হাত বার করে দিয়ে কোনো মোহিনী তনু জাপটে ধরেছে, আর রণ-রঙ্গিনী তাই থেকে বেঁকেচুরে গুমরে দুমড়ে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছে।