চোখে পলক পড়ে না রেখা মিত্রর। অদ্ভুত রূপান্তরটা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করছে। ঠক ঠক করে কাঁপছে মানুষটা। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে।
দরজা খুলে রেখা বাইরে এসে দাঁড়াল। অমর দত্ত বিড় বিড় করে বকে চলেছে। তখনো। উত্তেজনা বাড়ছেই। একটা ইনজেকশান নিয়ে রেখা আবার ভিতরে এলো। কনুইয়ে ভর করে অমর দত্ত আধা-আধি উঠে বসল প্রায়।আবার এসেছ? সুলেখা পাঠিয়েছে, কেমন? তোমাদের ভয়-ডর নেই? আমার কলমের ডগায় কত বিষ জানো?
-জানি, শুয়ে পড়ুন।
–ফাস্ট, ইউ গেট আউট।
ইনজেকশান আর আরকের তুলোটা এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে করে রেখা। তার কাঁধে আচমকা ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে দিল। এরকম একটা সবল নিষ্ঠুরতার জন্য রোগীও প্রস্তুত ছিল না। হকচকিয়ে গেল কেমন। ততক্ষণে তার সামনের বাহু উঠে এসেছে ওর শক্ত হাতের মুঠোয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ইনজেকশান শেষ।
…পাঁচ মিনিটও গেল না। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে রোগীর। তবু যতক্ষণ পারল চোখ টান করে সে দেখতে চেষ্টা করল এই নির্মম শুশ্ৰষাকারিণীকে।
ইনজেকশান রেখে নীরবে অপেক্ষা করছিল রেখা। সে ঘুমিয়ে পড়তে কাছে। এসে দাঁড়াল। বিছানাটা অবিন্যস্ত হয়ে আছে। টান করে দিল। চুলগুলো কপালের ওপর দিয়ে চোখে এসে পড়েছে। সরিয়ে দিল। গায়ের চাদরটা টেনে দিল বুক পর্যন্ত। নিঃশব্দে চেয়ে রইল তার পর। ঘুমন্ত মুখেও বহু দিনের একটা ক্লিষ্ট যাতনা সুপরিস্ফুট যেন। লোকটা ভালো কি মন্দ সে কথা এক বারও মনে আসছে না তো! তাদেরই এক জনের জন্য এই মানুষের সকল বৃত্তি হারাতে বসেছে। হঠাৎ মনস্তাত্ত্বিক কর্ণেলের ওপর ক্ষেপে আগুন হয়ে গেল রেখা মিত্র। তার সকৌতুক কণ্ঠস্বর যেন গলানো সীসে ঢেলে দিতে লাগল কানে, এ থার্ড কনসিকিউটিভ সাকসেস…।
এর পরের দুতিন মাসের চিকিৎসা-পর্বে নতুন করে বর্ণনার কিছু নেই। এক নারীর স্মৃতি মনে এলেই অমর দত্ত চিৎকার-চেঁচামেচি করে ওঠে তেমনি, নিঃস্ব হিম শীতল জীবনের হাহাকারে জলে-পুড়ে খাক হয়ে যায়। রেখা কখনো ঘর ছেড়ে চলে যায় তার কথা মত, কখনো বা উল্টে ধমকে ওঠে সুষ্ঠু অভিনেত্রীর মত, কখনো বা প্রণয়িনীর আকুলতায় কাছে এসে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শেষের দিকে একটু পরিবর্তন যেন উপলব্ধি করতে পারে। তর্জন-গর্জন তেমনি আছে, কিন্তু বেশিক্ষণ সে অনুপস্থিত থাকলে অসহিষ্ণুত্তাও বাড়ে।
-এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?
–বাইরে।
–কেন?
–আপনিই তো ঘর থেকে বার করে দিলেন।
–আপনি গেলেন কেন?
রেখা হেসে ফেলে, আচ্ছা, আর যাব না। কিন্তু আবারও তাকে যেতে হয়, আবারও আসতে হয়। তবু রেখা বোঝে, দিন বদলাবে। অনেক বদলাবে। কিন্তু বলে না কাউকে কিছু। কর্ণেলের নীরব প্রশ্ন এড়িয়ে যায়। সহকর্মিণীদের কৌতূহলও জানবার। বিশেষ করে বীণা সরকার ছাড়বার পাত্রী নয়।
–নতুন নাগরটি কেমন?
–ভালো।
–তবু, নমুনাটা শুনিই না একটু?
–মর্কটের মত।
–আঁচড়ে কামড়ে দেয়?
–দেয়নি, দিতে পারে।
বীণা সরকার হেসে ওঠে, কিছুতে পোষ মানছে না বল?
হেসে টিপ্পনী কাটে রেখা মিত্রও, ছোট ডাক্তারকে নিয়ে পড় গে না, আমাকে নিয়ে কেন।
অমর দত্ত ভালো হবে। এবারও এই বিধিলিপি। আরও মাস দুই পরের সেই বিশেষ মুহূর্তটির অপেক্ষা শুধু। রেখা রকিং চেয়ারে বসে হাসছে মৃদু মৃদু। অল্প অল্প দুলছে চেয়ারটা। অমর দত্ত নির্নিমেষ নেত্রে তার দিকে চেয়ে চেয়ে কি যেন দেখছে।
রেখা উঠে গায়ের এপ্রোনটা খুলে চেয়ারের কাঁধে রাখল। মাথার হুডটাও। খোঁপার আধখানা পিঠের ওপর ভেঙ্গে পড়ল। বসল আবার। রকিং চেয়ার সজোরে দুলে উঠল।
-কি হল?
–গরম লাগছিল।
–হাসছেন যে?
–এমনি।
–এমনি কেউ হাসে?
–তাহলে আপনাকে দেখে।
–আমি তো কুৎসিত দেখতে।
–ছিলেন, এখন মোটামুটি মন্দ নয়।
অমর দত্তও হাসতে লাগল। একটু বাদে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনি। আমার জন্য এতটা করেন কেন?
-কতটা করি?
–বলুন না শুনি?
-আপনি একজন এত বড় লেখক, আপনার জন্য করব না তো কার জন্য করব! কত লোক কত কিছু আশা করে আপনার কাছে।
হঠাৎ যেন একটা ঝাঁকুনি খেল অমর দত্ত। সমস্ত রক্ত যেন উবে গেল মুখ থেকে। নিঃসাড়, পাণ্ডুবর্ণ। আর্তকণ্ঠে বলে উঠল, এ তো সুলেখার কথা! সুলেখা বলত। আমার মত লেখক নেই, আমার জন্য সব পারা যায়, সব করা যায়। এর পর তারই মত বলে বেড়াবেন তো, আমি গরীব, খেতে-পরতে পাই নে ভালো করে, মুখে বসন্তের দাগ, পাগল-ছাগলের মত লিখি যা মনে আসে, দুরাশা দেখে হাসি পায়–বলবেন? বলবেন তো?
স্থির, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছিল রেখা। উঠে কাছে এলো।–সুলেখা এসব বলেছে?
-হা বলেছে, সর্বত্র বলেছে, হেসে আটখানা হয়ে বলেছে। আপনিও বলবেন, হাত বাড়ালেই বলবেন। আবার সে কাঁপতে সুরু করেছে, মুখে দুঃসহ যাতনার চিহ্ন।
কণ্ঠস্বর কান্নার মত শোনায় এবার।–আমি তো কোন অপরাধ করিনি। বুকের ভেতরটা জ্বলে-পুড়ে যেতে দেখলে আপনাদের এত আনন্দ হয় কেন? ভয়াবহ নিঃসঙ্গতায় হাড়-পাঁজর শুদু যখন ভেঙ্গে দুমড়ে একাকার হয়ে যায়, সে যাতনা বোঝেন? আকণ্ঠ পিপাসায় যখন…
আর কথা বেরুল না। বাহুতে মুখ ঢেকে ফেলল সে। রেখা আস্তে আস্তে হাতখানি সরিয়ে দিল আবার। এক পা মাটিতে রেখে শয্যায় ঠেস দিয়ে বসেছে। শুভ্র, নিটোল দুই হাতে মুখখানা ঘুরিয়ে দিল নিজের দিকে ঝুঁকে এলো আরো কাছে।