শোভনা বিশ্বাসের একটা বড় দোষ বা বড় গুণ, সে সক্কলের সঙ্গে যেচে আলাপ করতে ওস্তাদ। কোনো নামী ছেলে বা মেয়ের কথা শুনলে কতক্ষণে তাকে একটু নাড়াচাড়া করে দেখবে সেই ফাঁক খোঁজে। কলেজে পড়তে সায়েন্স গ্রুপ পড়াতেন এক প্রৌঢ় নাম-করা প্রফেসার। তার ছাত্ররা তাকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করত। কথায় কথায় শোভনা কার মুখে শুনল ভদ্রলোক ম্যাট্রিক থেকে এম. এস-সি পর্যন্ত ফার্স্ট ছাড়া কখনও সেকেন্ড হননি। কলেজ আঙিনায় ভদ্রলোককে সামনা-সামনি দেখেই এগিয়ে গিয়ে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম সেরে মুখোমুখি দাঁড়ালো।–আপনার হাতখানা একবার আমার মাথায় রাখুন তো সার।
ভদ্রলোক অপ্রস্তুত।-কেন বলো তো, তুমি কী পড়ো–কোন ইয়ারের ছাত্রী?
-বলছি! বিনীত নিবেদন, আগে আপনার হাতখানা একবার আমার মাথায় রাখুন না…।
কি আর করেন? রাখলেন।
-আমি বি, এ ফাইনাল ইয়ারের ইকনমিক্স-এর খুব সাধারণ ছাত্রী…ম্যাট্রিক থেকে এম. এস-সি পর্যন্ত একজন ফাস্ট হওয়া মানুষ জীবনে এই প্রথম দেখলাম সার, দোষ নেবেন না।
অতসী একটু পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছিল আর শুনছিল। কলেজ গেট পেরিয়ে হাসতে হাসতে বলল, হায়ার সেকেন্ডারি থেকে এম. এ, এম-এসসি পর্যন্ত ফাস্ট আজকাল অনেকেই হয়, এই ভদ্রলোকের অর্ধেক বয়সের সে-রকম কাউকে যদি সামনে দেখতিস?
-তাহলে মাথায় হাত রাখতে বলতে পারতাম না, আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে একবার জড়িয়ে উড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করত, ফার্স্ট বা ফার্স্ট ক্লাস ছেড়ে মোটামুটি সেকেন্ড ক্লাস যদি একটা হয়।
সেদিন লাইব্রেরি হলে দূরের টেবিলে একজনকে দেখা গেল। বিকেলে ওই টেবিলে তাকে প্রায়ই দেখা যায়। অতসীকে ক্লাসের পর নিয়মিত লাইব্রেরিতে এসে পড়াশুনা সেরে নিতে হয়। ফিরে গিয়ে দুদুটো টিউশনি আছে, সপ্তাহে তিন দিন করে পড়ায়, বাড়ি গেলে নিজের পড়ার সময় মেলে না। তাছাড়া বেশ অবস্থাপন্নর পক্ষেও এম. এ ক্লাসের সব বই কিনে পড়া সম্ভব হয় না, অতসীর তো নিজস্ব খুব কম বই-ই আছে। ছুটির দিনে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে পড়তে যায়। সেখানেও ওই ছেলেকে এক-আধ দিন দেখেছে। সামনা-সামনি পড়ে গেলে বা চোখাচোখি হয়ে গেলে পরিচিতের মতোই সামান্য হেসে পাশ কাটিয়েছে। অতসীও তাই করেছে। য়ুনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে আজ ওই দূরের টেবিলে মুখোমুখি একজন মাত্র সহপাঠী বসে। পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক কথা-বার্তা চলছে।
আঙুল তুলে অতসী ওই টেবিলটা দেখিয়ে বলল, ওই দ্যাখ, ম্যাট্রিক থেকে এম এতে ফার্স্ট না হলেও এখানকার একটি অলরাউন্ড রত্ন বিশেষ–তোর জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করার মতোই একজন সমর ঘোষাল।
শোভনা বেশ নিবিষ্ট চোখে দেখে নিল। দূরে হলেও এই দিকে মুখ করেই বসেছে। অস্ফুট মন্তব্য করল, আমার নয়, মনে হচ্ছে তোর ইচ্ছে করার মতোই একজন। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালো–চলি…। হাত
-ওকি! এই শোন–
কর্ণপাত না করে এগিয়ে চলল। সোজা ওই টেবিলে। দুদিকের দুজনেই এক সঙ্গে মুখ তুলল। শোভনা সহপাঠীর দিকে তাকালোও না, সমর ঘোষালকে বলল, আমাদের ওই টেবিলে একবারটি অনুগ্রহ করে আসার সময় হবে?
আঙুল তুলে টেবিল দেখালো। সমর ঘোষাল পঞ্চাশ গজ দূরের টেবিলে তাকালো। এবং অতখানি দূর থেকেই অতসী গাঙ্গুলীর সঙ্গে চোখাচোখি।
উঠল। ঠোঁটে মৃদু হাসির আভাস। আসছে। আগে আগে শোভনা। একটা বড় কাজ সমাধা করার মতো মুখ। এই টেবিলে এসে দুই ভুরু সামান্য কুঁচকে একটু ঘটা করেই আর এক দফা রত্নটিকে দেখে নিল। অতসীর মনে হল, যে এলো সে এই দৃষ্টিবাণে আহত বা বিড়ম্বিত হবার মতো একজন নয়।
গম্ভীর মুখে শোভনা বলল, সদ্য কলেজ উৎরানো দুটো কচিকাঁচা আমরা। সেখানে। ছেলে-মেয়ে সক্কলের সঙ্গে সকলের তুই তোকারির সম্পর্ক ছিল, এখানকার হাল কেমন, তুমি চলে না আপনি-আজ্ঞে?
তুমিটাই ভালো চলে।
-বেশ। অতসীর মুখোমুখি চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, ওই চেয়ারে পাঁচটা মিনিট বোসো তাহলে, একটু আলাপ পরিচয় সেরে নিই–
সমর ঘোষাল হুকুম তামিল করল, অর্থাৎ বসল।
–আমি শোভনা বিশ্বাস, খুব সম্ভব সেকেন্ডক্লাস লাস্ট হয়ে ইকনমিক্স পড়তে ঢুকেছি, এ হল…(থেমে গিয়ে একটু ভ্রূকুটির ঘটা) কেন, এর নামের সৌরভ এখনো। তোমার নাকে-কানে পৌঁছয়নি?
কানে পৌঁছেছে, অতসী গাঙ্গুলি, তোমার পাবলিসিটির গুণে ছেলেরা এই নাম নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে, পরিচিত হয়ে ধন্য হলাম, আমার নাম
–থাক, থাক, য়ুনিভার্সিটির আকাশে তুমি দীপ্ত সূর্য, তোমার আলোর গরিমায় চার দিকের নক্ষত্ররা টিপ টিপ জ্বলছে, এটুকু আমাদের জানা আছে। আমরাও গুণের কদর জানি
আর সেই কারণেই এ হেন গুণীকে জবরদস্তি ধরে আমরা একটু টানাটানি করে থাকি
খোঁটা দেবার সুরে অতসী বলল, আমরা বলে আবার আমাকে জড়াচ্ছিস কেন, নিজের কথা বল
সঙ্গে সঙ্গে শোভনার ভ্রূকুটি এবং ঝঝ। বেশি দেমাক দেখাস না, তোর মতো চেহারা আর বিদ্যের জোর থাকলে তোকে জড়াতে যাব, এতই বোকা ভাবিস আমাকে?
এবারে সমর ঘোষালের দুচোখ শোভনার দিকেই মনোযোগী একটু। তারপর হাল্কা-গম্ভীর মন্তব্য–নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, তোমার মতো চেহারা আর বিদ্যের জোরের। রসিকতার টানাটানিও ভালো না লাগার মতো উঁচু স্তরের কেউ নই আমি।
খুশিতে বিগলিত ভাব শোভনা বন্ধুর দিকে ফিরে ঠেস দিল, কি রে, শুনলি? খুব যে নাক সিটকোস