কিন্তু রেখা মিত্র কিছুই করছে না। শিথিল আলস্যে স্রেফ শুয়ে আছে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে। বুকের ওপরের বইখানা দেখলেও সহকর্মিণীরা হাঁ করে ফেলত হয়ত। বিবেকানন্দের কর্মযোগ। তুলে নিল। উল্টে-পাল্টে দেখল একবার। হঠাৎ ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে। ঘরের কোণে আলনার নীচে গিয়ে আশ্রয় নিল সেটা। উঠে বসল পা ঝুলিয়ে। পরনের বেশ-বাসের দিকে তাকালো একবার। চলে যাবে। ঠোঁটের কোণে হাসির আভাস। চোখের সামনে ভাসছে দুটি মুখ। সমরেশ চক্রবর্তী আর মাধব সোম। সুপুরুষ দুজনেই। কিন্তু পাগল হলে কি বীভৎসই না হয় মানুষ। প্রাণের জন্য চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে বলে গেছে। রেখা মিত্র নিজের মনেই হেসে উঠল।…তা থাকবে হয়ত।
আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। একটু প্রসাধন দরকার। বুড়ো কর্ণেল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে আবার। চোখ নয় ত, যেন দুখানা এক্স-রের কাঁচ। কিন্তু আয়নার দিকে চেয়ে চেয়ে আত্মবিস্মৃত তন্ময়তা নেমে এলো কেমন। চেয়েই আছে। দেখছে। কিন্তু কে দেখছে কাকে? কে রেখা মিত্র? ওই শুভশ্রী নারীমূর্তি? কি আছে ওতে।…রক্ত, মাংস, নীল নীল কতগুলো শিরা-উপশিরা। গা ঘিন ঘিন করে উঠল। তারপর?…শুকনো, কঠিন, কুৎসিত কঙ্কাল একটা। শিউরে উঠল আবারও। তাহলে কে দেখছে? আর বাকি থাকল কী?
দরজার গায়ে শব্দ হল ঠক ঠক করে। বিষম চমকে উঠল সে। আবার বেয়ারা পাঠিয়েছে নিশ্চয়। দরজা না খুলেই জবাব দিল, বলো গিয়ে এক্ষুনি যাচ্ছি। বুড়ো দেবে দফা সেরে। চটপট এপ্রোন পরে নিয়ে হুডটা মাথায় চড়ালো। জুতো বদলাতে গিয়ে আলনার নীচে কর্মযোগের দুর্দশা দেখে জিভ কাটল তিন আঙুল। তুলে নিয়ে ঝেড়ে-ঝুড়ে একবার কপালে চুঁইয়ে ড্রয়ারে রেখে দিল বইখানা।
নাকের ডগা থেকে চশমা কপালে তুলে দিলেন কর্ণেল।-বোসো। পেশেন্ট দেখেছ?
রেখা ঘাড় নাড়ল, দেখিনি।
–হাউ এ্যাবসার্ড। –এ থার্ড কনসিকিউটিভ সাকসেস উইল মেক ইউ এ ফিনিসড় এ্যাকট্রেস মাই ডিয়ার। হেসে কাজের কথায় এলেন, সেই কেস, সেইম ট্রিটমেন্ট। কিন্তু একটু গণ্ডগোল আছে।…নাটক নভেল কি সব লিখত টিকত। ইউ শুড বি মোর এলার্ট, এমনিতেই আধ পাগল এসব লোক। টাইপ-করা কেস-হিস্ট্রি বাড়িয়ে দিলেন তার দিকে, দেখো।
কাগজগুলো নিয়ে রেখা চোখ বুলোতে লাগল। এক অক্ষরও পড়ল না। কারণ, এবারে আর রোগী ভালো হবে না সে জানে। আর কিই বা হবে পড়ে! নিঃস্ব, রিক্ত, সর্বগ্রাসী শূন্যতার মাশুল দিচ্ছে সেই ইতিহাসই তো! তাকে নতুন করে রোগে ফেলতে হবে আবার। ভালবাসার রোগ। যে নারীর অমোঘ স্মৃতি মানুষটাকে দেউলে করেছে, বিকল করেছে, তার মূলশুদ্ধ উপড়ে ফেলতে হবে। কিছুদিনের জন্য তার মানসপটে অধিষ্ঠাত্রিণী হবে রেখা মিত্র। এটুকুই চিকিৎসা। তারপর এই নতুন রোগ আর কাঁচা মোহ ছাড়াবার কলাকৌশল ভালই জানেন মনোবিজ্ঞানী কর্ণেল। ছদ্ম-গাম্ভীর্যের আড়ালে রেখা হাসছে মনে মনে। বুড়োর সকল আশায় ছাই পড়বে এবার।
কিন্তু রেখা মিত্রর সঙ্কল্পে ছেদ পড়ল বোধ করি প্রথম দিনই। দোতলায় কোণের দিকে ঘর। কান পেতেও কোন সাড়াশব্দ পেল না। দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করল। স্প্রীং-বসানো দরজা আপনি আবজে যায় আবার।
বাহুতে চোখ ঢেকে শুয়ে আছে লোকটি। আধ ময়লা, রোগা মুখে এক-আধটা বসন্তের দাগ। সুশ্রী বলা চলে না কোন রকমে। পায়ের শব্দে চোখের ওপর থেকে হাত সরালো সে। হাসল একটু, নমস্কার, বেশ ভালই আছি আমি।
আগের দুজন রোগীর কাছে যাওয়াটাও নিরাপদ ছিল না প্রথম প্রথম। চোখে চোখ রেখে রেখা দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। সে আবার বলল, আপনাদের এই জায়গাটা, ভালো, বেশ নিরিবিলি, কোন অসুবিধে হচ্ছে না আমার। চোখের ওপর হাত নেমে এলো, আচ্ছা, দরকার হলে খবর দেবখন।
রেখা এগিয়ে এসে রোগীর চার্ট দেখে নিল, ঠিক ঘরে এসেছে কি না। অমর। দত্ত…। ঠিকই আছে। রকিং চেয়ারটায় এসে বসল। আধ ঘণ্টা কেটে গেল, টু-শব্দটি নেই। স্থাণুর মত পড়ে আছে মানুষটা। তারপর এক সময় হাত সরে গেল আবার। সবিস্ময়ে তাকালো সে, কি আশ্চর্য। সেই থেকে বসে আছেন আপনি? মিথ্যে কষ্ট করছেন কেন, দরকার হলেই আমি ডাকবখন, আপনি যান।
বিস্মিত রেখাও কম হয়নি।–আপনি ভাবচেন কী?
অস্ফুট শব্দ করে হেসে উঠল সে।একটা লাইন কিছুতে মনে করতে পারছি। নে সেই থেকে। সব দিতে সব নিতে যে বাড়াল কমণ্ডলু দ্যুলোকে ভুলোকে…তার। পর ভুলে গেছি। রবি ঠাকুর চুরি করেছে।…চুরি ঠিক নয়, আগে ভাগেই লিখে বসে। আছে। নইলে আমি লিখতুম। কিন্তু তার পরের কথাগুলো…
নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল রেখা মিত্র। হিরনেত্রে চেয়ে রইল।
–আপনার জানা আছে? নেই, না? সুলেখা কিন্তু ফস করে বলে দিত।
নামটা বলার সঙ্গে সঙ্গে যেন ইলেকট্রিক শক খেয়ে চমকে উঠল নিজেই। বিহ্বল, বিমূঢ়। মাত্র কয়েক মুহূর্ত। কঠোর কঠিন কতগুলো রেখা সুস্পষ্ট হল সারা মুখে। চোখের দৃষ্টি গেল বদলে। দুই চোখে আগুনের হল্কা। ঝুঁকে এলো সামনের দিকে।
–আপনি, আপনিও তো মেয়েছেলে?
রেখা চেয়ার ছেড়ে এক পা অগ্রসর হতেই সে গর্জে উঠল আবার।–দাঁড়ান। ওখানে। আমি জানতে চাই আপনি মেয়েছেলে কি না?
রেখা ঘাড় নাড়ল, মেয়েছেলেই বটে।
–যান আমার সুমুখ থেকে। আর কখনো আসবেন না। মেয়েদের আমি আর দেখতে চাই নে কোন কালে। কোন দিন না। এত বড় অভিশাপ আর নেই। দাঁড়িয়ে আছেন কি? যাবেন না? যান, যান, বলছি!