অদূরে নার্স কোয়াটার্স। বাঙ্গালী আর ফিরিঙ্গী মেয়ের জগা-খিচুড়ি। একে অপরের ইয়ারকি-ফাজলামোগুলো মক্স করে। দিশি মেয়ে মেম-সাহেবের বাংলা নকল করে মুখ ভেঙায়। মেমসাহেব দিশি মেয়ের পিঠে কিল বসিয়ে ছুটে পালায়। শিথিল অবকাশটুকু হাসি-ঠাট্টায় ভরাট থাকে।
তবু এরই মধ্যে একজনকে যেন সমীহ করে চলে ওরা। বাইরে নয়, মনে মনে। ঈর্ষা বলা যেত, কিন্তু সে কথা ভাবতে নিজেরাই লজ্জা পাবে। রেখা মিত্র, সিষ্টার ইনচার্জ। কর্তামো করে এ অপবাদ তার শত্রুও দেবে না। আগের বুড়ি ইনচার্জ যা। ছিল, বাবা। নাকের জলে চোখের জলে এক করে ছাড়ত। এ বরং ভালো, দরকার হলে উল্টে তড়পে আসা যায়। তাছাড়া ছিল তো ওদেরই একজন, এখন না হয় মাথার ওপর উঠে বসেছে। চ্যারিটি মিশনের মেয়ে না হলে এতদিনে বাড়ি-গাড়িওয়ালা ঘরে বরে ভরে যেত কোন কালে এ সকলেই উপলব্ধি করতে পারে। সারা দেহে রূপ আর স্বাস্থ্য যেন একসঙ্গে মাথা খুঁড়ছে। কিন্তু এ নিয়েও কটাক্ষ করে না কেউ। কারণ নিজেই সে নিজেকে আগলে রাখতে ব্যস্ত। প্রাচুর্যের আভাসটুকু অবশ্য ঢেকে রাখা সম্ভব নয়।
হাসপাতালের বড়কর্তা মনস্তাত্ত্বিক কর্ণেল পাকড়াশী। নামের মত মানুষটিও গুরুগম্ভীর। কাছে এলেই বুকের ভেতরটা গুরগুর করে ওঠে। নার্স, এ্যাসিসট্যান্ট সকলেরই। তারই দুদুটো উদ্ভট এক্সপেরিমেন্ট সফল করেছে রেখা মিত্র। নির্দেশ মত। নিখুঁত অভিনয় করেছে। এতটুকু ভুল হয়নি, এতটুকু ত্রুটি ঘটেনি। এক বছরের মধ্যে পর পর দুজন মৃত্যুপথযাত্রী বিকৃত-মস্তিষ্ক মানুষ সুস্থ নিরাময় হয়ে ঘরে ফিরে গেল। কর্ণেল পাকড়াশী লিপিবদ্ধ করছেন তাঁর গবেষণার ইতিবৃত্ত। হয়ত রেখা মিত্ররও নাম থাকবে তাতে। কিন্তু ইতিমধ্যে তৃতীয় রোগীর আবির্ভাব ঘটল। একই রোগ, একই কারণে মস্তিষ্ক-বিকৃতি। কর্ণেলর আগ্রহ বাড়ে। রেখা মিত্রর ডাক পড়ে তৃতীয় বারও। প্রথম সফলতার পরে সহকর্মিণীদের মনে হয়েছে মেয়েটা যেন বদলেছে একটু। দ্বিতীয় বারের পরিবর্তন আরো সুস্পষ্ট। কথা বলা কমিয়েছে। অকারণ হাসিখুশীটুকুও। চলনে বলনে কেমন যেন একটু বিচ্ছিন্নতা। ফিরিঙ্গি মেয়েরা সকৌতুকে নিরীক্ষণ করে তাকে। স্বজাতীয়দের মধ্যে চাপা অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে ফেলে কেউ কেউ, যশস্বিনী হয়ে পড়েছেন, প্রশংসায় পঞ্চমুখ সকলে, মাটিতে পা পড়বে কেন!
কর্তব্যবোধে আর একজন হয়ত থামাতে চেষ্টা করে তাকে, এই, শুনলে দেবেখন।
-শুনুক, কর্ণেলের পকেট-ঘড়ি হয়ে থাকলে অমন বরাত সকলেরই খুলত।
-যাঃ, মেয়ের মত মানুষ করেছে, কি আবোল-তাবোল বকিস? বিরক্তি প্রকাশ করেছিল নার্স মহলের দ্বিতীয় তারকা বীণা সরকার। শিক্ষা এবং রুচিজ্ঞান আছে। বুড়ি সিস্টার-ইন-চার্জের পর সেই হতে পারত সর্বেসর্বা। কিন্তু দুবছর আগে কোথা থেকে হুট করে বদলি হয়ে এলেন কর্ণেল, সঙ্গে এল রেখা মিত্র। তার দিন গেল।
এরই মুখ থেকে প্রতিবাদ শুনে পূর্বোক্ত শুশ্ৰষাকারিণী চুপসে গেল যেন। প্রসঙ্গ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিল, সেকথা কে বলেছে, আমি বলছিলাম অমন জয়ঢাক বাজাবারও কোন মানে হয় না। আসলে পুরুষগুলিই সব ভেড়া-মার্কা, রূপসীর মুখে দুটো নকল ভালবাসার কথা শুনেই গলে জল হয়ে গেল। পাগল না হাতী।
কিন্তু এও যে রাগের কথা সকলেই উপলব্ধি করতে পারে। দ্বিতীয় রোগীটির ভার কর্ণেল প্রথমে বীণা সরকারকেই দিয়েছিলেন। রেখা মিত্রর মতই সুনাম অর্জনের আশায় প্রাণপণ চেষ্টা করেছে কর্ণেলের নির্দেশ কলের মত মেনে চলতে। অভিনয়ে এতটুকু ফাঁক বা ফাঁকি ছিল না তারও। তবু পারল না। তাকে সরিয়ে কর্ণেল রেখাকে নিয়ে এলেন আবার। এখনো ভেবে পায় না, সেই মুমূর্ষ উন্মাদকেও সে কি করে ছমাসের মধ্যে একটু একটু করে সম্পূর্ণ নীরোগ করে তুলল।
দুর্নিবার কৌতূহলে ঠাট্টার ছলেই সে রেখাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কি করে কি করলি রে?
নিজের ঘরের চৌকাঠের কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল রেখা মিত্র। প্রশ্ন শুনে তার চোখে চোখ রেখে নীরবে চেয়েছিল কিছুক্ষণ। পরে তেমনি হালকা জবাবই দিয়েছে, গলা জড়িয়ে ধরে বললাম, ভালবাসি প্রিয়তম, আগের সব কথা ভোলো–
বীণা হেসে ফেলেছিল।–ভুলল?
শব্দ করে হেসে উঠেছিল রেখা মিত্রও।ভুললই তো।
বীণার মনে হয়েছে, ইচ্ছে করেই সে তার প্রশ্ন এড়িয়ে গেল, যশের ডালি ভবিষ্যতেও আর কাউকে ভাগ করে দিতে রাজি নয় বোধ হয়। ভু কুঁচকে বলল, তা এমন অভিনয় করিস যদি থিয়েটার বায়স্কোপে ঢুকে পড় গে যা না, হাসপাতালে পচে মরছিস কেন?
–পারি। হলিউড থেকে ডেকে পাঠিয়েছে। কিন্তু আমি গেলে তোর ছোট ডাক্তার হার্ট ফেল করবে, সেজন্যেই যেতে পারছি না।
হাসতে হাসতে মুখের ওপরেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। বীণা সরকার স্তব্ধ। …ছোট ডাক্তার নিখিল গুহ। রেখা মিত্র না এলে এতদিনে সত্যিই একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারত। সে জ্বালা আছেই। কিন্তু তবু রাগতে পারেনি। কারণ, আজ পর্যন্ত ছোট ডাক্তার এই মেয়েটির কাছ থেকে শুধু নীরস অবহেলা ছাড়া আর কিছু পায়নি। কর্ণেলের হাতের মেয়ে না হলে এতদিন এখানে আর চাকরী করতে হত না ওকে।
কিন্তু পুরানো কথা থাক। তিন নম্বর রোগী এসেছে। তৃতীয় বার ডাক পড়েছে। রেখা মিত্রর। নার্স কোয়ার্টারের আবহাওয়া চঞ্চল। কর্ণেলের তলব শুনলে পড়িমরি করে ছুটে যাওয়াই রীতি। কিন্তু ওর ঘরের দরজা বন্ধ এখনো। করছে কী? ঘুমুচ্ছে? না সাজছে?