ঠোঁট টিপে হেসে অতসী গাঙ্গুলি জিজ্ঞেস করে, তোদের ডক্টর ঘোষাল কেমন পড়াচ্ছে?
প্রায় দুবছর আগে সমর ঘোষালের ডক্টরেট হবার খবর অতসী ঠিকই রাখে।
–খুব ভালো, তবে বেজায় গম্ভীর আর সীরিয়াস। তার প্রসঙ্গ কেন নূপুরও জানে।
–সেটা বরদাস্ত করছিস নাকি তুইও! চোখে মুখে মজার হাসি।–এতদিন আমার কাছে কি শিখলি তাহলে?…এক কাজ করতে পারিস, মেয়েরা স্পেশাল সাহায্যের জন্য ছুটির দিনে তার বাড়িতে পড়তে আসত, গাম্ভীর্য আর সীরিয়াসনেস খাঁটি কি নকল বোঝার জন্য তুইও এ-সুযোগটা নিতে পারিস। ৩৭৪
নূপুর হেসেছে কেবল, জবাব দেয়নি।
বি এ ফাইনালের ছমাস আগে একদিন এসে খবর দিয়েছে, কি-যে মুশকিল হল, পরীক্ষাটার মুখে ডক্টর ঘোষাল এই য়ুনিভার্সিটি ছেড়ে কলকাতার না কোন যুনিভার্সিটির রিডার হয়ে চলে গেলেন।
অতসী গাঙ্গুলির মুখখানা তেতে উঠল।–যাবে না তো কি, নিজের স্বার্থ ছেড়ে কে আর আমার মতো তোদের জন্য প্রাণটা দিয়ে পড়ে থাকে।
ফাইনাল পরীক্ষার খবর বেরুতে নূপুর এসে জানালো জার্নালিজম নিয়ে এম-এ পড়ার জন্য সে কলকাতায় চলল। অতসী গাঙ্গুলি প্রথমে ভাবল, ওর মাথায় আসে। পরে মনে হল, এই সাবজেক্টই ওর পক্ষে ভালো, এ-লাইনে থাকলে গর্তের অনেক সাপ টেনে বার করতে পারবে, অনেকের মুখোশ ছিঁড়ে-খুঁড়ে দিতে পারবে।
.
আরো বছর আড়াই কেটে গেছে। অতসী স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হয়েছে। বেয়ারা তার হাতে একটা ডাকের খাম দিয়ে গেল। খামের লেখাটা চেনা-চেনা মনে হল। খাম খুলে দেখল তাই। নিচে নূপুরের নাম।
শ্রীচরণেষু,
অতসীদি, আশা করি আমাকে ভুলে যাননি। গত আড়াইটা বছর দ্রুত তালে কেটে গেল। জেনে খুশি হবেন, এম এ জার্নালিজম এ ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি। তার আগে থেকে একটা কাগজে শিক্ষানবিসি করছিলাম, এখন সেই কাগজের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছি।
আমাদের ব্যাচকে বিদায় দেবার কালে আপনি বলেছিলেন লয়েলটিটুকুই আপনার প্রাপ্য, আর কিছু চান না। অন্যদের কথা জানি না, আমি ভূলিনি। এখানে পড়ার সময় ইনভেসটিগেটিভ জার্নালিজম, বিষয়টির ওপর আমি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলাম। আপনার প্রতি লয়েলটির কথা ভেবে আমার প্রথম অনুসন্ধানের বিষয় ছিল বিবাহ বিচ্ছেদ। অন্য দেশ বা রাজ্যের নয়, কেবল এই বাংলার। ভেবেছিলাম কাজটা কঠিন হবে না, কিন্তু শুরু করে দেখি আমি অথৈ জলে। হাজার-হাজার কেস-এর ফয়সালা হয়ে গেছে, হাজার-হাজার পেনডিং কেস লাখের দিকে গড়াতে চলেছে। দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিদেশের মতো অদূর ভবিষ্যতে এখানেও ডিভোর্স কোর্ট গজাবে। কাগজের সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে কেস স্টাডি করার কিছু সুবিধে হয়েছে। ডিভোর্স ছাড়া গতি নেই এমন বেদনাকরুণ ঘটনা অবশ্যই অনেক পেয়েছি। কিন্তু সামগ্রিক সংখ্যার তুলনায় নগণ্য। শতেকে নব্বইটির কাছাকাছি দেখলাম বিচ্ছেদের মূলে ব্যক্তিত্বের সংঘাত পারসোনালিটি ক্ল্যাশ। কত তুচ্ছ কারণে এই সংঘাত স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে বিচ্ছেদের প্রাচীর তুলে দিতে পারে দেখে আমি তাজ্জব। পরস্পরের সদয় বোঝা-পড়ার চেষ্টা, একটু অ্যাডজাস্টমেন্টের চেষ্টা এমন নির্দয়ভাবে অনুপস্থিত হয় কি করে? এর নাম ব্যক্তিত্ব না সুপারইগো?–আত্মকেন্দ্রিক অহংকার? যাক, এর পরে বেছে-বেছে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে নেমেছিলাম। প্রথমেই কার কাছে গেছি আপনি নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন–ডক্টর সমর ঘোষালের কাছে। কলকাতায় এসে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। তার সাহায্য সর্বদাই পেয়েছি। এব্যাপারে দেখলাম একমাত্র তিনিই অকপট হতে পেরেছেন, নিজের দোষ-ত্রুটি স্বীকার করেছেন। অন্য স্ত্রী পুরুষদের বেশিরভাগ ডিভোর্সের পরেও আক্রোশ নিয়ে বসে আছেন, পরস্পরের বিরুদ্ধে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করছেন।
…এরপর আরো একটু সমাচার আছে। আসছে সপ্তাহে ডক্টর ঘোষালের সঙ্গে আমার বিয়ে। পারস্পরিক বোঝাপড়া বা অ্যাডজাস্টমেন্ট সম্ভব কিনা সেটা ষোল আনা যাচাই করে দেখার জন্য একজন ভুক্তভোগীকেই জীবনে টেনে নিলাম। লয়েলটির এর থেকে বড় প্রমাণ আপনার সামনে আর কি রাখতে পারি? অবশ্য আপনার তুলনায় আমার একটু সুবিধেও আছে। বয়সে তিনি আমার থেকে দশ-এগারো বছরের বড়, আর স্নেহ নিম্নগামী, চেষ্টা সত্ত্বেও আমার দিক থেকে বোঝাপড়ার ত্রুটি দেখলে স্নেহের দায়ে তিনি উপেক্ষা করবেন বা শুধরে দেবেন এই বিশ্বাস আর জোরও আমার মনে আছে।…এর মধ্যেও আপনার কথা আমি ভেবেছি। আপনার মানসিকতার অনাপোস জয় যদি এখনো চান, মনে হয় সে-সময়ও একেবারে ফুরিয়ে যায়নি, এখনো আপনি আমাদের আর্ট টিচার অমরেশ ঘোষের দিকে ফিরে তাকাতে পারেন। প্রণতা, আপনার। স্নেহের নূপুর।
ক্রোধে আর আক্রোশে অতসী গাঙ্গুলি কাঁপছে থরথর করে। সেই ক্রোধ আর আক্রোশ চোখ দিয়ে ভেঙে পড়তে শয্যায় আছড়ে পড়ল। অনেক-অনেকক্ষণ একভাবে পড়ে রইলো।…প্রথম ঘণ্টার ক্লাস মিস হয়ে গেছে। উঠল। মুখ-হাত ধুয়ে এসে সামান্য কুঁচকে যাওয়া শাড়িটা বদলে আরো একটু চকচকে শাড়ি পরল। অভ্যস্ত তৎপরতায়। আবার প্রসাধন সেরে নিল। আয়নায় দাঁড়িয়ে রক্তিম দুই কানে, নাকের ডগায়, দুচোখের কোণে আর একটু পাউডার বোলালো। ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে করিডোর। ধরে দ্রুত সিঁড়ির দিকে চলল। দ্বিতীয় ঘণ্টার ক্লাস না, মিস্ হয়।
দীপ জ্বেলে যাই
মেন্টাল অবজারভেটরি। ছবির মত ঝকঝক করছে বাড়িটা। সামনে-পিছনে বাগান। দুদিকের রাস্তাগুলো যেন কালো বার্ণিশ করা। ভিতরে জনা চল্লিশেক রোগী। রোগী বলা ঠিক হবে না। রোগিণীও আছে চৌদ্দ-পনের জন। আলাদা আলাদা ঘর। মক্তি বিকৃতির কারণ সকলের এক নয়। চিকিৎসা ব্যবস্থাও বিভিন্ন। ..