–কি হল, ভাবছ?
নূপুর মাথা নাড়ল, ভাবছে না।
–তাহলে লিখছ না কেন?
জবাবে সেই দুষ্টু-দুষ্টু মিষ্টি-মিষ্টি হাসি। বলল, দশ লক্ষ টাকা থাকলে আমি কিছুই করব না। এমনি চুপচাপ বসে থাকব।
এই মেয়েকে নিয়ে অতসী গাঙ্গুলি কি করে, কোথায় রাখে? হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ে সব মেয়েকেই বলল, থাক বাপু থাক, আমার ঘাট হয়েছে, কাউকেই আর এই এস্এ লিখতে হবে না।
সেকেন্ডারি পরীক্ষায় আরো দশ পনেরোটা নম্বর বেশি পেলে নূপুর সরকার স্কলারশিপ পেতে পারত। ক্লাস ইলেভেনে এসে নূপুর আর আরো সাতজন তার হাতের মুঠোয়। এদের সকলকে উদ্যোগী হয়ে সে ইকনমিক্সএ টেনে এনেছে। তাতে বাছাই ব্যাচের অবধারিত লিডার নূপুর সরকার। লিডার কাউকে করতে হয় না, ব্যাচের সব থেকে চৌকস মেয়েটি লিডার আপনি হয়ে বসে। এই লিডার বলতে যার পরামর্শ আর বুদ্ধি নিয়ে ব্যাচের অন্যরা চলে ফেরে ওঠে বসে, গুরুদেবীর ভাব-ভাবনা আয়নার মতো দেখতে পায়।
ক্লাস ইলেভেনে নূপুর ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছে। দেখা-মাত্র অতসী গাঙ্গুলির মনে হয়েছে কিশোরীর সমস্ত চিহ্ন মুছে দিয়ে চট করে মেয়েটা যৌবনের সিংহাসনে দিব্যাঙ্গনার মতো বসে গেল।
তার দিকে চেয়ে হাসিমুখে অভিনন্দন জানালো কংগ্রাচুলেশন!
-থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম।
পড়াশুনার মেজাজ আনতে গিয়ে সকলের উদ্দেশে অতসীর প্রশ্ন, আচ্ছা, ইকনমি বলতে তোমরা কে কি বোঝো বলো তো? নূপুর আগে বলো–
উঠে দাঁড়ালো। অতসী গাঙ্গুলি পুরুষের চোখ দিয়ে দেখছে ওকে, আর ভিতরটা ততো খুশি হয়ে উঠছে। এখন তো ছেনিখোন্তা মাল-মশলা সব তার হাতে, যাবে কোথায়!
নূপুর একটু ভেবে জবাব দিল, ইকনমি হল খরচ করার এমন একটা আর্ট, যাতে কোনো মজা নেই।
অতসী গাঙ্গুলি জোরেই হেসে উঠল।–আমার কাছে ফার্স্ট ক্লাস নম্বর পেলে, পরীক্ষার খাতায় গোল্লা।
নূপুর হাসতে হাসতে বসে পড়ল।
..দু বছরের মগজ ধোলাইয়ের ফাঁকে এই মেয়ে এমনি হাসির জবাব অনেক দিয়েছে।
প্রশ্ন : কমিউনিস্ট আর ক্যাপিটালিস্টের মধ্যে তফাৎটা কি চার-চারে আট লাইনের মধ্যে লেখ।
নূপুর সরকার দুলাইনের মধ্যে লিখেছে। কমিউনিস্ট বলবে এত কারো থাকা উচিত নয়। ক্যাপিটালিস্ট বলবে এতটা অন্তত সকলেরই থাকা উচিত।
প্রশ্ন : এ-দেশে প্রোটেকটিভ ফরেন হেল্প-এর চেহারাটা কেমন?
নূপুরের উত্তর : লাইক এ ফিমেল ড্রেস উইদাউট অবস্ট্রাকটিং দি ভিউ।
আর একটা তৎপর জবাব মনে পড়লে অতসী গাঙ্গুলি হেসে বাঁচে না। প্রঃ ছিল, ডাইরেক্ট ট্যাক্সেশন আর ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেশনের কিছু ভালো উদাহরণ দাও।
মেয়েরা লিখতে শুরু করে দিয়েছে। কোণের বেঞ্চ থেকে নূপুর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। দেহের ছাঁদ বদলেছে, কিন্তু চোখে আর ঠোঁটে সেই দুষ্টু-মিষ্টি হাসি লেগেই আছে।–একটা খুব রিয়েল আর ওরিজিন্যাল এগজাম্পল দেব ম্যাডাম?
–ও শিওর?
–আমার বউদি খরচের সতেরো ফিরিস্তি দিয়ে যে-টাকাটা আদায় করে নেয়, সেটা হল ডাইরেক্ট ট্যাক্সেশন। আর দাদা ঘুমিয়ে পড়লে যে টাকাটা তার পকেট থেকে হাতিয়ে নেয়, সেটা ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেশন।
এই উদাহরণ অতসী গাঙ্গুলির চিরদিন মনে থাকবে।
এ-ব্যাচেরও বারো ক্লাসের পরীক্ষা এসে গেল। মেয়েরা পড়াশুনায় ব্যস্ত। অতসী গাঙ্গুলিও তার বাছাই ব্যাচকে যতটা পারে এগিয়ে দেবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এ-বছরের মত তার মগজ ধোলাইয়ের পর্ব শেষ। সে পরিতুষ্ট, পরিতৃপ্ত। কেবল খেদ, নূপুর সরকারের মতো আবার একটি গড়ে তোলার মতো লিডার কবে পাবে।
এর মধ্যে আর্ট টিচার অমরেশ ঘোষ মুখখানা বেজার করে বলল, আপনার এবারের ব্যাচের ওই নূপুর সরকার মেয়েটি এত মিষ্টি এত ভালো, কিন্তু বেজায় ফাজিল। আমি তো হঠাৎ বুঝতেই পারিনি কি বলছে!
অতসী গাঙ্গুলি নূপুরের নাম শুনেই সচকিত একটু।–কেন, কি বলেছে?
–স্কুল থেকে কাল বাড়ি যাবার পথে রাস্তায় দেখা হতে আমাকে বলল, একটু নতুন কিছু আঁকুন না সার? কি-রকম জিজ্ঞেস করতে বলল, যেমন ধরুন, উমা নয়, শিব উমার জন্য তপস্যায় বসেছে গোছের…।
অতসী গাঙ্গুলি মনে মনে হেসে অস্থির। এ-রকম কথা নূপুর বলবে না তো কে বলবে। পরে ওর সঙ্গে দেখা হতে ছদ্ম কোপে চোখ পাকিয়েছে, এই মেয়ে আর্ট টিচার অমরেশবাবুকে কি বলেছিস?
ক্লাসের বাইরে নূপুর সরকারের এই ব্যাচটাকে তুমি ছেড়ে তুই বলা শুরু করেছিল। আর এই ব্যাচের মেয়েরাও বাইরে তাকে ম্যাডামের বদলে দিদি বলে। অতসীদি।
পরীক্ষা হয়ে গেল। বিদায়ের দিন এলো। অতসী গাঙ্গুলি প্রত্যেক ব্যাচকে বলে, নূপুর সরকারের হাত ধরে এই ব্যাচকেও তাই বলল।–মনে রেখো, ভালো যদি কিছু করে থাকি তোমাদের লয়েলটিটুকুই কেবল আমার প্রাপ্য, আর কিছু চাই না।
.
অতসী গাঙ্গুলির বাছাই ব্যাচের সব মেয়েরাই য়ুনিভার্সিটিতে ঢুকে ইকনমিক্স অনার্স পড়ে। এই ব্যাচে ব্যতিক্রম হল, নূপুর সরকার, ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হল। অতসী গাঙ্গুলি এই মেয়ের বেলায় সেটাই স্বাভাবিক ভেবেছে। এটাই ওর সব থেকে প্রিয় সাবজেক্ট।
মনে মনে ভাবল, এটা মন্দ হল না, একজনের সম্পর্কে টাটকা খবর কিছু কিছু পাওয়া যাবে।
এখন ওই প্রিয় ছাত্রীর বাড়িতে যাতায়াতও সহজ হয়ে গেছে অতসী গাঙ্গুলির। ফাঁক পেলে নূপুরও বোর্ডিং-এ এসে তার সঙ্গে গল্প করে, চা-চপ-কাটলেট রসগোল্লা সন্দেশ খেয়ে যায়।