তার বাছাই প্রথম ব্যাচের পাঁচটি মেয়ের মধ্যে বি. এ আর এম, এ পড়ার ফাঁকে চারটির বিয়ে হয়ে গেছল। তাদের মধ্যে দুজনের ডিভোর্স হয়ে গেছে, একজনের ডিভোর্স কেস কোর্টে ঝুলছে। চতুর্থজন তার স্বামীকে ভেড়া বানিয়ে রেখেছে। পঞ্চমজন একের পর এক প্রত্যাশীদের বাতিল করে চলেছে। অতসীকে সে বলেছে তারও স্কুল টিচার হবার ইচ্ছে। হলে তো সোনায় সোহাগা। একবার যারা তার কেনা হয়ে গেছে, সময় আর সুযোগ হলেই তারা তাদের গুরুদেবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। অতএব অতসী সকলের সব খবর পায়।..দ্বিতীয় ব্যাচের চারজনের মধ্যে বিয়ে হয়েছে দুজনের, একজনের ডিভোর্স কেস কোর্টে ঝুলছে, অন্যজন কোন এক বড় কোম্পানির রিসেপশনিস্ট-এর চাকরি জুটিয়ে স্বামীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে গেছে। বাকি দুজন প্রার্থীর আশায় ছাই ঢেলে চলেছে। তৃতীয় আর চতুর্থ ব্যাচের সাত আর ছয় তেরো জন এখনো অপেক্ষাকৃত নতুন। পুলকিত হবার মতো ঘটনা এখনো ঘটেনি বটে। কিন্তু যোগাযোগ কারো না কারো সঙ্গে হয়ই। যাকে দেখে, কথা-বার্তা শুনে হাসি-খুশির আত্মপ্রত্যয় লক্ষ্য করে অতসীর মনে হয় প্রত্যেকে তার নিজস্ব জগতের সম্রাজ্ঞটি হয়েই বসে আছে। তারা তাদের দিনের অপেক্ষায় আছে।
এবারের বাছাই আটটি মেয়ের ব্যাচের যে-মেয়েটি লিডার, তার ওপর অতসী গাঙ্গুলির চোখ আরো চার বছর আগে থেকে। ও মেয়ে যখন তার ছাত্রীই নয়, তখন থেকে। এখন বদ্ধ বিশ্বাস তার এতদিনের সব বাছাই মেয়েদের ওপর দিয়ে এই মেয়ে টেক্কা দেবে। দেবার মতো সমস্ত গুণই তার মধ্যে দেখেছে। মনে মনে অতসী গাঙ্গুলি তাকে বুকে আগলে রেখেছে।
…চার বছর আগের সেই কৌতুক প্রহসনটুকু ভোলার নয়। কোন টিচার অ্যাবসেন্ট থাকলে প্রিন্সিপালের হুকুম-মতো লিজার-আওয়ারের টিচার তার ক্লাস নিতে যায়। ক্লাস এইটের ম্যাথস টিচার অনুপস্থিত। অতসী গাঙ্গুলি তার ক্লাস নিতে ঢুকেছিল। ছাত্রী না হলেও সব ক্লাসের মেয়েরাই তাকে দেখলে খুশি হয়।
মেয়েদের ফ্র্যাকশন জ্ঞান দেখার জন্য অতসী ছোট্ট একটু বুদ্ধির অঙ্ক দিয়েছিল। একটা ফেন্স মানে বেড়ার মধ্যে পনেরোটা ভেড়া আছে, আর তাদের জন্য তিরিশ দিনের খাবার মজুত আছে। কিন্তু একটা ভেড়া ফেন্স টপকে পালিয়ে গেল। তাহলে বাকি চৌদ্দটা ভেড়ার ওই মোট খাবারে আরো কতদিন চলবে?
প্রশ্ন শুনে অনেক মেয়েরই ধাঁধা লেগে গেল। অনেকেই কলম নিয়ে খাতার ওপর ঝুকল। কোণের বেঞ্চের একটি মেয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। ভারী সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে, মুখে আর চোখে দুষ্টু-দুষ্টু মিষ্টি-মিষ্টি হাসে, এখনই বেশ লম্বা আর। সুডৌল স্বাস্থ্য, এক মাথা ঝাকড়া কোকড়া চুল। ছাই রংয়ের ওপর টকটকে লাল বর্ডার দেওয়া স্কুল ড্রেসে চমৎকার মানিয়েছে।
অতুসী গাঙ্গুলি জিজ্ঞেস করল, হয়েছে?
মাথা নাড়ল, হয়নি। তার পরেই প্রশ্ন শুনে অবাক।-ম্যাডাম, যে-ভেড়াটা ফেন্স টপকে পালালো সেটা কি পালের গোদা ভেড়া?
অতসী গাঙ্গুলি হাঁ কয়েক পলক।–তার সঙ্গে অঙ্কের কি সম্পর্ক?
–গোদা ভেড়া হলে তিরিশ দিনের খাবারই পড়ে থাকবে, বাকি চৌদ্দটা ভেড়াই ওটার পেছু পেছু ফেন্স টপকে পালাবে।
অতসী গাঙ্গুলি হেসে সারা, মেয়েরা আরো বেশি। হাসি থামতে বলল, আচ্ছা। গোদা ভেড়া নয় ধরে নিয়েই করো।
মেয়ে জবাব দিল-এর আর করার কি আছে, একটা ভেড়ার দুদিনের খাবার চৌদ্দটা ভেড়া খাবে–এর একটার ভাগে ওয়ান-সেভেনথ পড়বে, তাহলে টু ওয়ান সেভেনথ ডে চলবে।
বসে পড়ল। অতসী গাঙ্গুলির চোখে মুখে ঠোঁটে হাসি। হুকুম করল, দাঁড়াও।
তক্ষুনি উঠে দাঁড়ালো।
তোমার নাম কি?
–নূপুর সরকার।
-কংগ্রাচুলেশনস্, তোমাকে আমার মনে থাকবে। অন্য কয়েকটি মেয়ে বলে উঠল, ও ব্রাবর আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল ম্যাডাম।
অতসী গাঙ্গুলি মনে রেখেছে। পর পর দুবছর তাকে ফার্স্ট প্রাইজ নিতে দেখেছে। সঙ্গে ইংরেজির আরো অনেক প্রাইজ নিতে দেখেছে। ক্লাস টেনে উঠে তার ছাত্রী হয়েছে। অতসী গাঙ্গুলি ইংরেজি এস এ-কম্পোজিশন ক্লাস নেয়, প্রিন্সিপাল না এলে ইংরেজি টেক্সটও পড়াতে হয়। প্রিন্সিপালের থেকে মেয়েরা তার ক্লাসেই। বেশি মজা পায়। নূপুর সরকার তখনো অতসী গাঙ্গুলির বাছাই ব্যাচের কেউ নয়, বাছাই ব্যাচ সে ঘেঁকে তোলে এগারো আর বারো ক্লাসের মেয়েদের থেকে। কিন্তু এই একটি মেয়ের প্রতি আগে থাকতেই ষোল আনা মনোযোগ তার। শুধু চেহারাপ দেখার মতো হয়ে উঠেছে তা-ই নয়, দুষ্টুমিও বাড়ছে। এর ওপর তার সুন্দর ইংরেজি লেখা।
গেল সপ্তাহে এসএ লিখতে দিয়েছিল, এ পুওর গার্লস কনস্ট্রাকটিভ ফিউচার প্ল্যান। এ-রকম উদ্ভট বিষয় নিয়ে লিখতে মেয়েরা মজা পায়। যে যতটা পারে বুদ্ধি ফলাতে চেষ্টা করে। অতসী গাঙ্গুলি এতদিনে জানে নূপুর সরকার এখানকার একজন নামী ডাক্তারের মেয়ে, তার দাদাও ডাক্তার। কিন্তু গরীব মেয়ের ফিউচার প্ল্যান রচনায় কোনো মেয়েই তার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারল না। সুন্দর লিখেছে।
.
পরের সপ্তাহে এর উল্টো রচনা লিখতে দিল সকলকে। ধরো তোমাদের প্রত্যেকের কাছে দশ লক্ষ করে টাকা আছে, এবারে যার যার কনস্ট্রাকটিভ ফিউচার প্ল্যান লেখ।
সবাই দ্বিগুণ মজা পেয়ে লিখতে বসে গেল। একটু বাদে অতসী গাঙ্গুলির চোখ গেল, নুপূর সরকারের দিকে। সে লিখছে না, চুপচাপ বসে আছে।