অতসীর এখন সাতাশ চলছে, সতের বছর বয়েস থেকে পুরুষের চোখের স্তুতি দেখে অভ্যস্ত, চিনে অভ্যস্ত। অতসী হলপ করে বলতে পারে সে এই স্কুলে আসার পনেরো দিনের মধ্যে ওই ভদ্রলোক তার প্রেমে পড়ে গেছে। আর মাস তিনেকের মধ্যে তো আপনারজনের মতো আচরণ তার। এখন স্কুলেই দুচারটে কথাবার্তা বলার ফাঁক খোঁজে। মাঝে-সাজে অতসী বিকেলের দিকে একটু হাঁটতে বা বেড়াতে বেরোয়। কিছুটা নিরিবিলিতে বেড়ানোর একটাই জায়গা। মহানন্দার দিকে গেলে তার সঙ্গে দেখা আর কথা হবেই। না গেলে অনুযোগ, যে একঘেয়ে জীবন আমাদের, হাঁটা চলার অভ্যাসটুকু ছাড়বেন না, শরীর মন দুই-ই ভালো থাকে, কিন্তু আপনি একদিন আসেন তো পাঁচ দিন আসেন না।
অতসী হাসে, যতটুকু সম্ভব সদ্ভাব রেখেই চলে। তাকে নিয়ে টিচারস রুমে আলোচনা হয় বলে ভদ্রলোক বিরক্তি প্রকাশ করে এবং বেশির ভাগ কি নিয়ে আলোচনা হয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তা-ও প্রকাশ করে দেয়।
অস্বস্তি গিয়ে অতসীর বরং সুবিধেই হয়েছে। বাইরে বোঝা যায় না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে বেপরোয়া হয়ে উঠতে পেরেছে। এর ওপর বোর্ডার টিচার তিনজনের মুখে প্রিন্সিপাল তার পড়ানোর প্রশংসা শুনে আর স্বচক্ষে ছাত্রীদের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ মেলামেশার ফল দেখে আরো প্রসন্ন। ওই তিন টিচারের একজনকে বলেছিল, দ্য গার্ল হ্যাঁজ আ চার্মিং পারসোনালিটি অফ হার ওউন-ভেরি ডিফারেন্ট ফ্রম আদার।
এরপর আর পরোয়া কাকে করে?
.
একে একে চার বছরে চার-চারটে ব্যাচ অতসী গাঙ্গুলির হাত দিয়ে হায়ার সেকেণ্ডারি পাশ করে বেরিয়ে গেল। প্রত্যেক ব্যাচের থেকে প্রত্যেক ব্যাচের ওপর অতসী গাঙ্গুলির হিসেবী আধিপত্য বিস্তার বেড়েই চলেছে। ব্যাচ বলতে সকলে নয়, অতসীর নিজস্ব বাছাই ব্যাচ, অন্য টিচারদের বিবেচনায় ওই দেমাকী টিচারের বিদ্রোহী ব্যাচ। তাদের চাপা আক্রোশ অতসী গাঙ্গুলি মেয়েগুলোর মগজ ধোলাই করে ছেড়ে দিচ্ছে। যে মেয়েরা মুখের দিকে চেয়ে কথা বলত না, তার সেই বাছাই মেয়েগুলো দেখতে দেখতে সেয়ানা হয়ে উঠছে, হেসে-হেসে তর্ক করে ভেবা-চ্যাকা খাওয়ার মতো মুখ করে প্রশ্ন করে, বুদ্ধিমতীর মতো তির্যক মন্তব্য করে, টিকা-টিপ্পনী কাটে।
যেমন, সোস্যাল সায়েন্সের বয়স্ক টিচার কি আলোচনা প্রসঙ্গে একজনের স্মরণীয় উক্তি কোট করেছিলেন, ম্যারেজ ইজ এ গ্রেট ইনস্টিটিউশন–অতসী গাঙ্গুলির এক সুশ্রী পেয়ারের ছাত্রীর আলতো মন্তব্য, মে বি, বাট হু ওয়ান্টস টু লিভ ইন অ্যান ইনস্টিটিউশান?
…ইংরেজি টেক্সটের এক গল্পে বর-কনের বিয়ের বর্ণনা ছিল। দেখতে সুশ্রী একটি ভালো ছাত্রীর হঠাৎ প্রশ্ন, বিয়ের সময় কনের ধপধপে সাদা পোশাক কেন?
শিক্ষয়িত্রীর সাদাসিধে জবাব, সাদাটা শান্তি আর আনন্দের প্রতীক, মেয়েদের সেটা সব থেকে আনন্দের দিন।
তক্ষুণি প্রশ্ন, বরের গায়ে তাহলে কালো পোশাক কেন, তার কি তাহলে সেটা সব থেকে অশান্তি আর নিরানন্দের দিন?
নিজের বিয়ে-ভাঙা কপাল নিয়ে ওই রূপসী টিচার মেয়েগুলোর মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে না তো কি? কিছু বলারও উপায় নেই, খামখেয়ালি প্রিন্সিপালের দিনে-দিনে চোখের মণিটি হয়ে বসছে। খুশি হয়ে তার উঁচু ক্লাসের ইংরেজিরও অর্ধেক দিন এই একজনকেই পাঠিয়ে দিয়ে নিজে বসে বসে লজেন্স চকোলেট খায়। আবার অবাকও হয়, অতসী গাঙ্গুলির বাছাই মেয়েগুলোর একটারও যদি পরীক্ষার ফল খারাপ হত, ইকনমিক্স-এ তো সক্কলের ভালো নম্বর। অবাক কেবল ড্রইং মাস্টার অমরেশ ঘোষ হয় না, বলে আপনার হাতে পড়ে মেয়েগুলো সব সোনার টুকরো হয়ে উঠছে সেটা যদি এঁরা দেখতেন, কেবল হিংসের কথা–
অতসী গাঙ্গুলির ঠোঁটের ফাঁকে একটু মজা-ছোঁয়া হাসি লেগেই থাকে। প্রশ্রয়ের সুরে জিজ্ঞেস করে, কেন, কি বলেন…?
ও-টুকুতেই উৎসাহে টুপটুপু ভদ্রলোক, আর বলেন কেন, ভালো কারো সহ্য হয়, আপনি নাকি নিজেকে এডুকেশন ফ্যাক্টরি ভাবেন একটা, সিলেবাস বা নিয়ম টিয়মের ধার ধারেন না, কেবল পড়ানোর চমক দেখান, মেয়েগুলোকে আস্কারা দিয়ে আদরে বাদর করে তুলছেন।
এই চার বছরে ভদ্রলোকের দুর্বলতা মেয়েরাও টের পেয়ে গেছে, বিশেষ করে অতসী গাঙ্গুলির বাছাই ব্যাচের মেয়েরা। নিজেদের মধ্যে তারা হাসাহাসি কানাকানি করে, বলে, কেন বামন কি চাঁদের দিকে হাত বাড়ায় না–নইলে কথাটা এলো। কোত্থেকে?
…অতসী গাঙ্গুলির আত্মবিশ্বাস ওই কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়োর মতো ঊর্ধ্বমুখী এখন। কাঁচা তাজা একটি মেয়েকে তার হাতে ছেড়ে দাও, তার দখলে থাকতে দাও, দেখবে বরাবরকার মতো সে তার হয়ে গেল। অতসী গাঙ্গুলি কল্পনায় তাই দেখছে, তাই বিশ্বাস করছে, অদূর ভবিষ্যতে তারা তার প্রতিশোধের এক-একখানা হাতিয়ার হয়ে উঠছে। আপন-আপন জগতে তারাও এক-একটি সম্রাজ্ঞী হয়ে উঠছে। কেবল যে মেয়েদের তার চাই তাদের মোটামুটি সুশ্রী হতে হবে, পুরুষের চোখ টানার মতো কিছু প্রসাদ গুণ (অতসী গাঙ্গুলির ভাষায় ন্যাচারাল ভাইটালিটি উইথ প্রসপেকটিভ ফেমিনাইন কারুভস) তাদের থাকতে হবে। এটুকু থাকলে রুচি-বোধ, প্রখর বিচার বিবেচনা-যুক্তিবোধ, সব থেকে বেশি স্বাধীনচেতা আত্মবোধের স্বাদ আফিম গিলিয়ে আপন আপন জগতে তাদের এক-একটি সম্রাজ্ঞী করে তোলা এখন কঠিন ভাবে না অতসী গাঙ্গুলি। এরাই তার প্রতিশোধের ভবিষ্যৎ হাতিয়ার।