-খুব ভালো।…তাহলে এই কথাই রইলো, এই বড় দিনের ছুটিতেই আমরা কলকাতা যাচ্ছি, আমি আজ থেকেই আর ফিরছি না, সেখানে মেয়েদের হস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে নেব, স্কুলের টেলিফোন নাম্বার রেখে যাব, তেমন দরকার হলে ইউনিভার্সিটি থেকে তুমি ফোন করতে পারো।
-হ্যাঁ, এতবড় ব্যাপারেও অতসী ধীর স্থির সম্রাজ্ঞীর ভূমিকা নিতে পেরেছে। সমর ঘোষাল সে তুলনায় কেবল স্তব্ধ, এবং তাজ্জব।
অতসীর এটুকুই সান্ত্বনা।
.
ঘোষাল নয়, অতসী গাঙ্গুলী স্কুলে বসে সমর ঘোষালের ফোন পেয়েছে সাড়ে তিন মাস বাদে। ও-দিকের গলার স্বর ঠাণ্ডা–তোমার একটা চিঠি এসেছে, মনে হয়। দরকারি…।
-কোত্থেকে?
–খামে এখানকার মেয়ে স্কুলের ছাপ দেখলাম।
-ও…! অতসীর গলায় আগ্রহ স্পষ্ট।-কি করা যায় বলো তো, রিডাইরেক্ট করলে তো আবার পেতে দেরি হয়ে যেতে পারে।
সমর ঘোষালের গলায় গম্ভীর শ্লেষ, আমাকে হাতে হাতে পৌঁছে দিতে বলছ?
ভিতরে যতই জ্বলুক, অতসীর গলায় সম্রাজ্ঞীর হাসি।খুব ইচ্ছে করলে নিয়ে : আসতে পারো…কেন, তোমার সেই ছাত্রীরা বাড়িতে পড়তে আসা বন্ধ করে দিয়েছে?
রাগে থমথমে গলা সমর ঘোষালের। ফোন ছেড়ে দেব?
-না, চিঠি এই রাতটা তোমার কাছেই থাক, আমি কাল ভোরের ট্রেনে গিয়ে নিয়ে নেব, মনে হয় ওখানকার স্কুলের চাকরিটা হল।…থ্যাংক ইউ।– ইচ্ছে করেই সমর ঘোষাল সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। অতসী আসতে শেরিং তার হাতে চিঠি তুলে দিয়েছে। অতসীর ফর্সা মুখ লাল। সম্রাজ্ঞীর ভূমিকায় দাঁড়িয়েই সে এখানে এসেছিল।
প্রিন্সিপাল মিসেস খাসনবিশের টাইপ করা দুলাইনের চিঠি। যত শীগগির সম্ভব দেখা করার নির্দেশ।
.
সীট ডাউন প্লীজ! লোমশ হাত দুটো টেবিলে রেখে মিসেস খাসনবিশ সামনে ঝুঁকলেন, এনিথিং সীরিয়াসলি রং উইথ ইউ?
অতসী হঠাৎ ভেবাচ্যাকাই খেয়ে গেল। মনে মনে এই স্কুলে চাকরিতে জয়েন। করার নিশ্চিত আশা নিয়েই এসেছে। শুকনো গলায় বলল, বেগ ইওর পারডন। ম্যাডাম?
মিসেস খাসনবিশ এটুকুতেই অসহিষ্ণু।তোমার জলপাইগুড়ির হেড-মিসট্রেস জানালেন, হাসব্যান্ডের সঙ্গে তোমার ডিভোর্স হয়ে গেছে, তবু আমি তোমার দরখাস্ত থেকে এখানকার ঠিকানা বার করেই চিঠি দিলাম, জাস্ট টু অ্যাভয়েড সাসপিশন অফ মাই কাউন্টার পার্ট দেয়ার, সি লাইকস ইউ ভেরি মাচ, এই স্কুলের খাম দেখলে তার প্রথমেই সন্দেহ হত, আমি তোমাকে ভাঙিয়ে নেবার মতলবে খাম দেখলে তার প্রথমেই সন্দেহ হত, আমি তোমাকে ভাঙিয়ে নেবার মতলবে আছি, অ্যান্ড থট এ য়ুনিভার্সিটি প্রোফেসার শুড আফটার অল বি এ জেন্টলম্যান। –দ্য লেটার শুড রিচ ইউ! নাও টেল মি হোয়াটস দি ম্যাটার-হোয়াট আই হার্ড…এ ফ্যাক্ট?
নানান অসুবিধে এড়ানোর জন্য জলপাইগুড়ির হেডমিসট্রেসকে বলতে হয়েছিল, চাকরি হলে এখানেও গোপন করা যাবে না। অতসীর মনে ভয়ই ধরে গেল, এর জন্যে মিসেস খাসনবিশ কি তাকে বাতিল করে দেবেন?
জবাব দিল, ঠিকই শুনেছেন…।
–বাট হোয়াই…মে আই নো?
–বনিবনা হচ্ছিল না…ঠিক অ্যাডজাস্ট করা যাচ্ছিল না।
–দ্যাট সিম্পল? সেটলড ইট মিউঁচুয়ালি?
অতসী মাথা নেড়ে সায় দিল। মহিলার দিকে চেয়ে কেন যেন একটুও ক্ষুব্ধ। মনে হল না তাঁকে। প্রশ্ন শুনে আরও আশান্বিত।আর ইউ হ্যাপি ইন জলপাইগুড়ি অর স্টিল ওয়ান্ট টু কাম হিয়ার?
–আজ বললে আজই জয়েন করতে পারি।
থলথলে মুখখানা হাসি হাসি।–ইউ হ্যাভ সাম লাক অ্যাট লিস্ট, যাঁর জায়গায়। তোমাকে নেবার কথা বলেছিলাম প্রিপারেটরি টু রিটায়ারমেন্ট লিভ-এ যাচ্ছেন, ইউ মে জয়েন নেক্সট মানডে-ইউ আর অতসী হোয়াট নাও?
গাঙ্গুলি…।
–ওকে–কাম্ উইথ এ ফ্রেশ অ্যাপলিকেশন।
এই শিলিগুড়িতেই আবার জীবন শুরু অতসীর। অতসী গাঙ্গুলির। মনে হয়েছে, এই ডিভোর্সের ফলেই প্রিন্সিপাল মিসেস খাসনবিশের তাকে নিয়ে নেবার আগ্রহ আরো বেড়েছে। কিছু দিন যেতে ধারণাটা আরো মনে বসে গেছে।…মহিলা তার কোয়াটারস এ একা থাকেন, স্কুলেরই দুটো ক্লাস ফোর কর্মচারী তাঁর বাবুর্চি এবং পরিচারক। টিচাররা সকলেই জানে তার স্বামী বর্তমান, কিন্তু চর্মচক্ষে কেউ সে ভদ্রলোককে কখনো দেখেনি। ভদ্রমহিলার যেমন মেজাজ তেমনি যাকে বলে হুইমজিকাল। আর খেতেও খুব ভালবাসেন। দুতিন জন পেয়ারের টিচারকে মাঝে মাঝে বাড়িতে ডেকে এনে খাওয়ান। স্কুল কম্পাউন্ডের মধ্যেই মেয়েদের বোর্ডিং, আলাদা আলাদা ঘর নিয়ে। একপাশে জনাকয়েক টিচারও থাকে। অতসীরও এখানেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আধ বয়সী বোর্ডার টিচার তিনজনেই অবিবাহিত এবং অনেকটা নিঃসঙ্গ বলেই প্রিন্সিপালের স্নেহের পাত্রী হয়তো, কেবল তাদেরই নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো হয়। বরাত জোরে অতসীও এদের সঙ্গে যুক্ত এখন। স্বচক্ষে মিসেস খাসনবিশের খাওয়ার বহর দেখে মনে হয়েছে, গতরখানা এমন হবে সে আর দোষের কি। মহিলার নতুন বয়সের চেহারাখানা কল্পনা করতে চেষ্টা করেছে।…পুরুষ অতসীর দুচোখের বিষ এখন, তবু কারো সঙ্গে এই মহিলার সুখের সংসার-জীবন ভাবতে গিয়ে হাসিই পেয়েছে।
জলপাইগুড়ি ছেড়ে এখানে আসতে পেরে অতসী ভেবেছিল তার অতীত নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না, সকলে তাকে কেবল অতসী গাঙ্গুলী বলেই জানবে।…কিন্তু এসব ব্যাপার বোধহয় গোপন থাকেই না। টিচাররা তো জেনেইছে, মেয়েদেরও জানতে। খুব সময় লাগেনি। হতে পারে এদের কারো-কারো সঙ্গে যুনিভার্সিটির কারো ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। হতে পারে ওই জাঁদরেল প্রিন্সিপালই পেয়ারের তিন বোর্ডার শিক্ষয়িত্রীকে বলে দিয়েছেন। না, মুখে তাকে কোনো টিচার এ নিয়ে একটি কথাও বলেনি। কিন্তু তাকে নিয়ে কথা আর কানাকানি যে হয় এটা খুব ভালোই বুঝতে পারে।…ঘুরিয়ে। ফিরিয়ে সে সম্বন্ধে কিছু আভাস দেবার লৌকও একজন এই কটা মাসের মধ্যে জুটেছে। স্কুলে মোট পাঁচজন পুরুষ টিচার আছে। তিনজনই সায়েন্স গ্রুপের, একজন জিওগ্রাফি টিচার, আর একজন অপেক্ষাকৃত কম বয়সের আর্ট বা ড্রইং টিচার অমরেশ ঘোষ। বোর্ডার টিচারদের মুখে অতসী জেনেছে স্কুল কমিটির একটি বিশিষ্ট মুরুব্বির জোরে বছর তিনেক আগে অমরেশ ঘোষের এখানে চাকরি হয়েছে। বছর পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ হবে বয়েস। অবিবাহিত।