সমর ঘোষাল খুব ভালো করেই জানে ভদের অনটনের সংসারে অতসীর বন্ধনের। শিকড়টা কোনদিনই খুব গভীরে পৌঁছয়নি। এখনো মাঝে মাঝে মা-কে টাকা পাঠাতে হয় বলে তার বিরক্তি লক্ষ্য করেছে। পরের বোন দুটো অকর্মা বলে রাগ করে।
তৃতীয় বারে অতসী সঙ্গে আসেইনি। তার সাফ কথা, তোমার তো এখন ডক্টরেট হওয়ার স্বপ্ন, আর আমার লিভ ভেকেন্সির চাকরি কবে আছে কবে নেই ঠিক নেই, আমার তো চেষ্টা কিছু করতে হবে না এভাবেই চলবে?
–ছুটির মধ্যে কোথায় কি চেষ্টা করবে?
–আমার যেটুকু চেষ্টা ছুটির মধ্যেই করতে হবে, স্কুল কামাই করে চেষ্টা করতে গেলে যা আছে তা-ও যাবে–তাছাড়া এই ডেলি প্যাসেঞ্জারির চাকরি আর কতকাল। করব?
তর্ক না বাড়িয়ে সমর ঘোষাল তাকে রেখে একলাই চলে গেছে। আর অতসী দুর্জয় রাগে ফুঁসেছে।…ডেলি প্যাসেঞ্জারের চাকরি আর ভালো লাগে না এটা ঠিক, তা বলে চাকরি যাবার ভয় আর তেমন নেই বললেই চলে। যার জায়গায় আছে সেই মহিলা বিনে মাইনেয় আরো এক বছরের ছুটিতে। এলেও এই দেড় বছরে পড়ানোয় তার যা সুখ্যাতি হয়েছে, আর মেয়েদের কাছে সে এত পপুলার এখন। যে হেডমিসট্রেস তাকে এক-রকম আশ্বাসই দিয়ে রেখেছেন ওখানে থেকে গেলে ভবিষ্যতের ব্যবস্থা তিনিই করতে পারবেন। এদিকে এখানকার বড় স্কুলে চাকরির আশার দিনও এগিয়ে আসছে। এই দেড় বছরের মধ্যে অতসীর প্রিন্সিপাল মিসেস খাসনবিশের সঙ্গে দুবার দেখা হয়েছে। দুবারই পুজোর পর গিয়ে দেখা করাটা শ্রদ্ধানিবেদনের সাক্ষাৎকারই বলা চলে। মিসেস খাসনবিশ অখুশি হননি। বলেছেন, ইওর হেডমিস্ট্রেস স্পিক্স হাইলি অফ ইউ, রোসো আরো কিছু দিন দেখি কি করতে পারি।
একটা তুচ্ছ উপলক্ষ্য ধরেই অতসী ঠাণ্ডা মাথায় শেষ ফয়সালা করে ফেলল। এই লোকের কাছে তার সম্রাজ্ঞীর আসন টলে গেছে, এটা স্পষ্টই বুঝেছে। কিন্তু সম্রাজ্ঞী নিজে এ আসনচ্যুত হতে রাজি নয়, এই এক ব্যাপারে তার কোনো আপোস নেই। অতএব শেষ ফয়সালার কিছু একটা উপলক্ষ্য কেবল দরকার ছিল।
ইদানীং সমর ঘোষালের কাছে তিনটি মেয়ে পড়তে আসছিল। ছুটির দিনে সকালে বা সন্ধ্যায়। অতসী তাদের ধারে কাছে যেত না, ফরমাশ মতো শেরিং চা দিয়ে যেত। মেয়েরা মাস্টারমশায়ের স্ত্রীকে দেখার জন্য বা একটু আলাপ করার জন্য উৎসুক বুঝেও সমর ঘোষাল এটা-ওটা বলে কাটিয়ে দিয়ে গম্ভীর মুখে কাজ সারার জন্য ব্যস্ত হয়।
দিন কয়েক এটা দেখে অতসী সোজাসুজি জিগেস করেছে, এরা টাকা দিয়ে বাড়তি বিদ্যার্জন করতে আসে না এমনি?
-এমনি।
–ছেলেরা বুঝি আজকাল আর পড়াশুনা নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না, যত চাড় মেয়েগুলোরই?
বক্রোক্তির জবাবে ভ্রূকুটি।
–ছুটি-টুটির দিনে এ-রকমই তাহলে চলবে এখন?
–কেন, তোমার অসুবিধে হচ্ছে?
-খুব বেশি রকম অসুবিধে হচ্ছে! দুখানা মাত্র ঘর, উঠতে বসতে চলতে ফিরতে অসুবিধে হয় কিনা তুমি বোঝো না?
সমর ঘোষালের উষ্ণ জবাব, এরা খেলা করতে আসে না, দুখানা ছেড়ে দশখানা ঘর হলেও তোমার অসুবিধেই হত…মনটাকে আর একটু উঁচুতে তুলতে চেষ্টা করো অতসী।
-কি? কি বললে তুমি? তোমার নিজের মন এত উঁচুতে এখন যে ওই মেয়েগুলোকে আমি হিংসে করি এ-ও ভাবতে পারলে তুমি? ওরা আমার ঈর্ষার পাত্রী?
অতসীর গলা খুব চড়ছে না কিন্তু দুচোখ দিয়ে গলগল করে বিদ্বেষ ঠিকরোচ্ছে।–চুপ করে না থেকে জবাব দাও!
-আমি কিছুই ভাবি না, ভাবতে চাই না–তুমিই ভাবিয়ে ছাড়ছ।
দেহের রক্ত-কণা মুখে আগেই জমছিল। মুখ থেকে চোখের দিকে ছুটেছে।
অন্য ঘরে চলে গেল। রাতে দুজনে মুখোমুখি বসে খাওয়া সারল, কেউ একটি কথাও বলল না। রাতে সমর ঘোষালের ঘুম আসতে দেরি হল। অতসী তখনো শয্যায় আসেনি। সকালে ঘুম ভাঙতে শয্যার দিকে তাকিয়েই বুঝল রাতে সে এ-ঘরে আসেনি।
সকালের প্রক্ষালন সেরে টেবিলে এসে বসল। মুখোমুখি চেয়ারে অতসীও। শেরিং পেয়ালা চায়ের পট টোস্ট-এর ট্রে টেবিলে রাখতে অতসী দুজনের পেয়ালাতেই চা ঢালতে ঢালতে শেরিংকে বলল, ঠিক হ্যায়
শেরিং টেবিল ছেড়ে সরে গেল। দুজনে দু-জনের পেয়ালা শুধু তুলে নিল, টোস্ট পড়ে থাকল। নিঃশব্দে দুটো চুমুক দেবার পর খুব ঠাণ্ডা গলায় অতসী বলল, শোনো, আমি ভেবে দেখলাম এ-ভাবে আর বাইরের ঠাট বজায় রেখে চলতে চেষ্টা না করাই ভালো, তাতে দিনে দিনে অশান্তি আরো বাড়বে।
পেয়ালা মুখের কাছেই ধরা, সমর ঘোষালেরও ঠাণ্ডা প্রশ্ন, কি করতে চাও?
–করার একটাই আছে, আমার মনে হয় যত ঠাণ্ডা আর শোভনভাবে সেটা করা যায় দুজনের পক্ষেই ততো ভালো।
–ডিভোর্স…?
অতসীর ভুরুর মাঝে ভাজ পড়ল একটু। এইটুকুই জবাব। চায়ের পেয়ালা খালি করে সামনে রাখল।
পেয়ালায় বার দুই চুমুক দিয়ে সমর ঘোষাল জিগ্যেস করল, তোমার এ ডিসিশন ফাইনাল তাহলে?
–হ্যাঁ, ভাঙা পেয়ালা জুড়তে চেষ্টা না করাই ভালো…আমার যতদূর ধারণা, বনিবনা হল না আর চিন্তাধারায় খাপ খেল না বলে মিউঁচুয়াল কনসেন্টে ডিভোর্স চাইলে ব্যাপারটা সহজেই ফয়সালা হয়ে যায়…যায় না?
-তা যায়।
-তাহলে তাই করো, সামনের বড় দিনের ছুটিতে আমরা কলকাতা চলে যাই…কিন্তু আমার দিকের কোনো উকিল জানাশোনা নেই…তোমার আছে?
সমর ঘোষাল সন্তর্পণে এক বড় নিঃশ্বাস তল করে নিল।–বাবার এক বিশেষ বন্ধুই এ সবের বড় উকিল, তোমার ব্যবস্থাও তিনি করে দিতে পারবেন। ব্যাপারটা তাতে সহজ হবে।