সমর ঘোষালের ভেবা-চ্যাকা খাওয়া মুখ।-কেন, তোমার পছন্দ হল না?
-না হলে কি করব, টি সেটের এত হালকা রং কদিন চকচকে থাকবে? ডিনার সেটের ডিজাইন আবার তেমনি জবরজং-এ বাপু চলবে না, বদলে নিয়ে এসো।
তিন বার করে ছোটাছুটি করে সমর ঘোষালের হাঁপ ধরার দাখিল, আর দোকানদারও বিরক্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অতসীর ষোল আনা পছন্দের জিনিস আনাই গেল না।
অতসীর সময় কম, এটা ওটা আনার হুকুম হয়ই। নতুন আর এক সেট জানলা দরজার পর্দার কাপড় আনতে বলে গেছে। একটু বেশি দাম দিয়ে যতটা সম্ভব পছন্দের জিনিসই আনতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু দেখামাত্র মুখ গম্ভীর এবং বিরূপ মন্তব্য। তোমাকে আনতে বলাই আমার ভুল হয়েছে, কি যে টেস্ট না তোমার–এত দাম। দিয়ে এই জিনিস নিয়ে এলে! থান থেকে কেটে এনেছ আর তো বদলানোও যাবে না—
টেস্ট-এর কথা শুনেই সমর ঘোষাল খাপ্পা।–এগুলো তাহলে রাস্তায় ফেলে দাও, টাকা দিচ্ছি নিজের পছন্দের জিনিস নিয়ে এসো, আর কোনদিন আমাকে কিছু আনতেও বোলো না।
অতসীর কানের দিকটা লাল হয়ে উঠছে।–তোমার পছন্দের সঙ্গে আমার পছন্দ যদি না মেলে তাতে রাগের কি ভুল?
সঙ্গে সঙ্গে তির্যক জাব, আমার পছন্দের সঙ্গে তোমার পছন্দ মেলে বলেই তুমি আমার কাছে এসেছ।
-তার মানে? তুমি দয়া করে আমাকে এনেছ?
–না, তুমি দয়া করে এসেছ।
চায়ের টেবিলে এমনি তুফান লেগেই আছে।
অতসীর নিজের পছন্দের কিছু কিনতে হলেও চলনদার হিসেবে সমর ঘোষালকে সঙ্গে থাকতেই হয়। দুটো বেড-শিট আর পছন্দসই একটা বেড-কভার কেনা হবে। প্রথমটা নিয়ে যাচাই বাছাইয়ের প্রশ্ন নেই। অনেক দেখে যে দুটো বেড-কভার নিয়ে বিবেচনা, সমর ঘোষালের চোখে তার একটা তো ভারী সুন্দর লাগল। কিন্তু মতামত জিগেস না করা পর্যন্ত সে চুপ।
-বলো, এ দুটোর কোনটা নেব?
সমর ঘোষাল সঙ্গে সঙ্গে, আঙুল তুলে দেখালো, ওইটা অনেক বেশি সুন্দর।
ধারণা, অতসীরও ওটাই বেশি পছন্দ। কিন্তু বলার সঙ্গে সঙ্গে তার খুঁতখুঁতুনি বাড়তে থাকল। দুটোই আবার পাশাপাশি খুলে দেখা হল। তারপর মন্তব্য, ভালো তো…কিন্তু একটু বেশি গরজাস। আরো একটু বিবেচনার পর অন্যটাই দোকানদারের দিকে এগিয়ে দিল, নাঃ, এটাই দিন।
সমর ঘোষাল নিঃসংশয়, সে কিছু না বললে আগের পছন্দের জিনিসটাই ঘরে আসত।
কাউকে চায়ে বা ডিনারে ডাকলেও এমনি তুচ্ছ কারণে মতবিরোধ। ঘরে কেবল চা-কফি ভিন্ন আর কিছু হয় না। সবই, সবই কোনো ভালো রেস্তোরাঁ থেকে আসে। সমর ঘোষাল যদি বলে, কাজু খাস্তা কচুরি চিকেন-কাটলেট আর ভালো কিছু সন্দেশ আনাও তো অতসী ভুরু কুঁচকেই প্রথমে সব বাতিল বুঝিয়ে দেবে, তারপর বলবে, কাজুর যা দাম তার বদলে চিপস করলেই হয়। আজকাল ওসব কচুরি মিষ্টি-টিষ্টি অচল। তার থেকে চীজ পকোড়া ফিশ-ফিংগার চিকেন প্যাটিস আর মিষ্টির বদলে পেস্ট্রি অনেক ভদ্রস্থ হবে। ডিনারে একজন যদি বলে বিরিয়ানি ফিশফ্রাই কোর্মা চাটনি। মিষ্টি হোক, অন্যজন অবধারিত বলবে, অত তেল মশলার হেভি মেনুর দরকার কি, তার থেকে ফ্রায়েড রাইস ফ্রায়েড প্রন চিলি-চিকেন আইসক্রিম হলে খারাপ হবে কিছু?
ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে এসে ঘরে ফিরে অতসী কিছুটা ক্লান্ত থাকে ঠিকই। মুখ হাতে জল দিয়ে বেশ খানিকক্ষণ শুয়ে থাকে। কিন্তু সে-সময় সমর ঘোষালের কাছে। যুনিভার্সিটির কেউ এলে আর গৃহিণীর খোঁজ করলে তাকে ডাকতেই হয়। অতসীর ফর্সা মুখ থমথমে হয়ে ওঠে। গলা দিয়ে চাপা ঝঝ বেরিয়ে আসেই।–তোমার কি দয়ামায়া বলে কিছু নেই? আমি কি তোমার শো-কেসের পুতুল, যে আসবে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে দেখাতে হবে!
বাইরের লোক চলে যেতে তার পরেও তপতপে মুখ দেখে সমর ঘোষালও রেগে গিয়ে একদিন কেবল বলেছিল, কে তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়ে ওই চাকরি করতে বলেছিল, ছেড়ে দিয়ে দেখো না আমি চালাতে পারি কি না?
সঙ্গে সঙ্গে অগ্ন্যুৎপাত।–কি বললে? আর আমি যদি বলি তোমার চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেখো। আমি চালাতে পারি কিনা–ছাড়বে? তোমার চাকরিটা চাকরি আর আমারটা নয়?
কিন্তু সমর ঘোষাল রিসার্চের কাজে আর পড়াশুনায় মন ঢেলে দিতে, দেখা গেল অতসী সব দিন আর অত ক্লান্ত থাকে না।
খানিক বাদে শয্যা ছেড়ে উঠে আসে, কাছাকাছির মধ্যে ঘুর ঘুর করে, এটা ওটা টুকটাক পরামর্শের দরকার হয়, কিছু কেনার কথা মনে পড়ে, নয়তো কারো বাড়িতে বা কোথাও যেতে ইচ্ছে করে।
সমর ঘোষাল বিরক্ত হয়, আমাকে রিসার্চের কাজটা ভালোভাবে করতে দেবে না কি?
খুব গায়ে মাখে না, ঠোঁটে হাসির আভাস দেখা দেয়। সেদিন বলল, ডক্টরেট হয়ে তোমার বিদ্যেবুদ্ধি আর এমন কি বাড়বে?
–বিদ্যেবুদ্ধি একটুও বাড়বে না, সামনে এগোবার রাস্তাটা পরিষ্কার হবে।
–সেটা কত এগোবার রাস্তা-রিডার প্রোফেসার ভাইস চ্যান্সেলার পর্যন্ত? কথার সুরে শ্লেষ, তখন তোমার স্কুল মাস্টার বউ মনে ধরবে তো?
সমর ঘোষালের আগে যা মনে হয়নি এখন তা হয়।
…সে এম. এ তে ফার্স্ট ক্লাস না পাওয়ার দরুন এই একজনেরই কোনো আক্ষেপ দেখেনি, প্রস্তুতি সত্ত্বেও তার আই এ এস পরীক্ষা দেওয়া বন্ধ করেছে, আর আজও তার নাগালের বাইরে যোগ্যতা আর প্রতিপত্তি অর্জন করুক এটা চায় না।
গত দেড় বছরের মধ্যে সমর ঘোষাল বার তিনেক কলকাতায় গেছে। অতসী দুটো ভেকেশনে সঙ্গে এসেছে, কর্তব্যের দায়ে দুতিন দিনের বেশি শাশুড়ীর কাছে থাকেনি, বাপের বাড়িতে থেকেছে। সমর ঘোষালের কাছে এ-ও কম দৃষ্টিকটু ঠেকেনি, কারণ বয়স্কা বিধবা মা তাদের অপেক্ষায় দিন গোনে, বউকে বুকে আগলে রাখতে চায়। কিন্তু এ নিয়ে কিছু বললে অতসী তেতে ওঠে। বলে, এখানে এসে তো বেশির ভাগ সময় তুমি তোমার রিসার্চের প্রোফেসার আর বই-পত্র নিয়ে কাটাও, আমার কাহাতক ভালো লাগে–নিজের মা-বাবা ভাই বোনের কাছে কটা দিন থাকবো। তা-ও দোষের?