ব্যাগ খুলে তৎপর হাতে অতসী অ্যাপ্লিকেশনটা বার করে খসখস করে নিজের নাম সই করল। তারপর একটু থমকে জিগেস করল, ডেট দেব?
-ও সিওর…আই অলওয়েজ ওয়ান্ট টু বি ফেয়ার-ডেট, উইল ক্লেইম প্রায়রিটি, হু নোজ দ্যাট দি প্রেজেন্ট ইকনমিক্স টিচার উইল নট কুইট, আরলিয়ার…আই ডোন্ট লাইক হার, নাইদার সি ডাজ মি, নাও আই হ্যাভ ওয়ার্কস, টু ডু উইশ ইউ গুড লাক।
বলবে না বলবে না করেও হেসে গড়িয়ে কর্তাটির কাছে প্রিন্সিপাল মিসেস। খাসনবিশের তাকে কুমারী ভাবার কথাটা না বলে পারল না। আগে ইন্টারভিউর আদ্যোপান্ত বলে পরে এটুকু শুনিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে হতাশায় যেন ভেঙে পড়ে সমর ঘোষাল অতসীর গা-ঘেঁষে শুয়ে পড়ল।–তাহলে বোঝ, ঝানু মহিলারাই তোমাকে কুমারী ভাবছে, পুরুষেরা হামলে পড়বে না কেন?
তাকে ঠেলে সরাতে চেষ্টা করে অতসী হাসতে হাসতে বলল, কিন্তু আমার তো মনে হয়, আমাকে কুমারী ভেবে ঠকেছেন বলেই উনি পরে বেশি সদয়।
সমর ঘোষাল তড়াক করে উঠে বসেছে, মিসেস খাসনবিশ সধবা না বিধবা?
জব্দ করার জন্যেই অতসী জবাব দিল, সবাই শুনেছি, কিন্তু কপালে সিঁথিতে সিঁদুরের বংশও নেই (শেষেরটুকু সত্যি)।
সমর ঘোষাল চোখ পাকালো তুমি আর ওই স্কুলের ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে না।
দেখা গেল চাকরির ভাগ্য অতসীরও খারাপ নয়। জলপাইগুড়ি স্কুলের চাকরিটা পেল। হেড মিসট্রেস তাকে পরের সপ্তাহ থেকেই জয়েন করতে বলেছেন। সমর ঘোষালও আপাতত নিশ্চিন্ত। এখান থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করা কঠিন কিছু নয়। সমূহ বিচ্ছেদের সম্ভাবনা থাকল না।
কৃতজ্ঞতা আর ধন্যবাদ জানাতে অতসী তার পরদিনই এখানকার মেয়ে স্কুলের প্রিন্সিপাল মিসেস হৈমন্তী খাসনবিশের সঙ্গে দেখা করতে ছুটল। এবার দিনের সাক্ষাৎকারের মিয়াদ মিনিট দুই তিন। বললেন, দ্যাটস ইয়োর লাক, আই অ্যাম গ্ল্যান্ড। ওঠার আগে একবার শুধু জিগেস করলেন, যে পোস্ট-এই যাও হোল-টাইম সীনিয়র টিচারের ইলেভেন টুয়েলভ ছেড়ে ক্লাস নাইন টেন-এও পড়াতে হয়…হোয়াট এলস। ইউ ক্যান্ টিচ?
–বি. এ পাএ ম্যাথস্ ছিল..ইংরেজিও পড়াতে পারি।
অতসী পিছু হটার মেয়েই নয়।
–থিংক, দ্যাট উইল ডু, ও, কেউইশ ইউ গুড লাক এগেন।
উঠে আসার আগে অতসী সবিনয়ে বলল, আমাকে যদি আপনি একটু মনে রাখেন…
জবাবে জাঁদরেল মহিলার দুচোখ ওর মুখের ওপরে উঠে এলো।–ডোন্ট ওয়ারি, আই উইল গেট রিপোর্টস ফ্রম মাই কাউন্টার-পার্ট দেয়ার।
সাদা কথায় তার ছাত্রী পড়ানোর কেরামতির খবর এখানে বসেই তিনি পাবেন, মনে রাখা না রাখা এর ওপর নির্ভর করবে। অতসী আর কথা বাড়ানো নিরাপদ বোধ করল না।
.
যে সহজ এবং সরল ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ প্রায় সম-বয়সী একটি ছেলে আর একটি মেয়েকে এত কাছাকাছি টেনে এনেছিল, সেই ব্যক্তিত্বের সংঘাতেই দুজনের দুদিকে ছিটকে যেতে দুবছরও সময় লাগল না। অবশ্য এই ব্যক্তিত্ব তখন আর পরস্পরের কারো কাছেই সহজ বা সরল মনে হয়নি। ভুল দুজনেরই। স্বভাব বা ব্যক্তিত্ব কারোই বদলায়নি, কিন্তু গোড়ায় সেটা বুঝতে ভুল হয়েছে। প্রাথমিক মোহ কেটে যেতে এই ভুল দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
অতসীর ভুল, বিদ্যায় বুদ্ধিতে চাল-চলন আচার-আচরণে পাঁচজনের চোখে পড়ার মতো একজন জোরালো পুরুষকে জীবনের দোসর হিসেবে পেতে চেয়েছিল। সমর ঘোষালের মধ্যে এই গুণগুলোই সে পুরোমাত্রায় দেখেছিল। নিজের ওপর এমনি প্রবল আস্থা যে, বিয়ের পর ধরেই নিয়েছিল এই জোরালো পুরুষটি এর পর ষোল আনা তার। ধরে না নেওয়ার কারণও নেই, একে একে তার সমস্ত ইচ্ছে মেনে নেবার পরেই এই বিয়ে। এর পরেও এই জোরালো পুরুষের সত্তসুষ্ঠু নিজের দখলে টেনে আনতে পারবে তাই বা ভাবতে যাবে কেন? এটুকু পারার মধ্যেই আনন্দ, পরিতৃপ্তি। নিজের জগতে বরাবরই সে একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী। সম্রাজ্ঞীর জগতে গুণধর শক্তিধর পাত্রমিত্র থাকবে বই কি। কিন্তু তার ইচ্ছের বোল আনা অধীনে থাকবে। সম্রাজ্ঞীর জগতের সে সম্রাট হলেও একই কথা। তারও ইচ্ছের অধীনে না থাকাটা বিদ্রোহের সামিল।
এখানেই ভুল অতসীর। তার ঘরের পুরুষের প্রবলতর সত্তার হদিশ সে পায়নি।
সমর ঘোষালের ভুল, অতসীর সব-কিছুর মধ্যে সে অনাড়ম্বর চরিত্রগত দৃঢ়তা। দেখত, সহজ ব্যক্তিত্বের মহিমা আবিষ্কার করত। মোহগ্রস্ত না হলে তার মতো মানুষের অনাপোস প্রবল ইচ্ছা আর ব্যক্তিত্বের মধ্যে তফাৎটা চোখে পড়ার কথা। চোখে পড়ার মতো অনেক নজিরই তো তার সামনে ছিল, যা তখন পড়েনি। আর তার ফলে। সমর ঘোষাল নিজেও মোহগ্রস্ত হয়ে ছিল না তো কি?
খিটির মিটির বাধতে লাগল অতি তুচ্ছ সব ব্যাপার নিয়ে। দোষের মধ্যে সমর ঘোষালের সবেতে উৎসাহ, সবেতে আগ্রহ। বাড়িতে লোক-জন আসা শুরু হয়েছে, ঘরে ভালো এক প্রস্থ টি-সেট ডিনার সেট এনে রাখা দরকার। শুনেছে ফ্যান্সি মারকেটে এ-সব খুব ভালো পাওয়া যায়। কিন্তু সবকিছু সেখানে সাদা পথে আসে না বলে পুলিশের হানাদারিও হয় শুনেছে। ছোট বড় হাঙ্গামাও বাধে। তাই অতসীকেও সঙ্গে নিতে ভয়। কিন্তু একলা গেলে সমর ঘোষালের আর ভয়ের কি আছে, চোরাই মাল। তো আর কিছু কিনতে যাচ্ছে না। স্কুল করে ট্রেনে ফিরে বাড়ি পৌঁছুতে অতসীর প্রায় রাতই হয়ে যায়। এই ফাঁকে তাকে খুশি এবং অবাক করে দেওয়ার জন্য সমর ঘোষাল একাই ফ্যান্সি মার্কেটে চলে গেছে। তার বিশ্বাস অনেক দেখে আর যাচাই বাছাই করে চোখ-জুড়ানো জিনিসই এনেছে। কিন্তু দেখে শুনে অতসীর ঠাণ্ডা মুখে চাপা বিরক্তি, তোমাকে এমন সর্দারি করতে কে বলেছিল, আর দুটো চারটে দিন। সবুর সইলো না?