- বইয়ের নামঃ রূপসী বাংলার মুখ
- লেখকের নামঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আতসী
অতসী একটি ফুলের নাম। স্বর্ণাভ। দেখতেও মিষ্টি।
অতসী গাঙ্গুলির বন্ধুরা এই ফুলের সঙ্গে নামের মালিকের তেমন মিষ্টি গোছের। মিল দেখতে পায়। বন্ধু বলতে য়ুনিভার্সিটির ছেলে-মেয়েরা। এই মিলটা তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বা ধরিয়ে দিয়েছে অতসী গাঙ্গুলির ছেলেবেলার বন্ধু শোভনা বিশ্বাস। সে-ও তারই সঙ্গে কলেজ ডিঙিয়ে ইকনমিক্স পড়তে ঢুকেছে। এই মিল দেখানোর পিছনে একটু বাস্তব রসের যোগ আছে।…যে কলেজ থেকে তারা পাশ করে বেরিয়ে এসেছে, সেখানকার দুজন তরুণ শিক্ষক ওই ফুলের সঙ্গে এই মিল। আর মিতালিটুকু প্রথম আবিষ্কার করেছিল। তাদের একজন সেটুকু সামনা-সামনি ঘোষণা করার মতো সাহস দেখিয়েছিল। অতসী গাঙ্গুলি খুব খুশি হয়ে তাকে চপ কাটলেট খাইয়ে বিদায় করেছিল। তারপর ওই মন-পসন্দ নামের মালিকের কাছ থেকে আশানুকুল সাড়া না পেয়ে ভদ্রলোক আর একদিন বাড়িতেও এসেছিল। দূর থেকে অতসীকে সে দোতলার ঘরের জানলার কাছে কয়েক পলকের জন্য দেখেও ছিল। আর অতসীও তাকে দেখেই সরে এসেছিল।
বাড়ির কাজের লোকটি এসে খবর দিতেই অতসীর সাফ জবাব, বলে দাও বাড়ি নেই, কখন ফিরব তারও ঠিক নেই।
এই অতসী-স্তুতি সেখানেই শেষ। শুনে শোভনা বিশ্বাস বলেছিল, এত অকরুণ। হতে পারলি কি করে–গোলাপে কাটা থাকে জানি, অতসীতেও থাকে।
দ্বিতীয় মিল-আবিষ্কারক ওই কলেজের বাংলার তরুণ কবি-শিক্ষক। উঠতি কবি হিসেবে ভদ্রলোকের বেশ সুনাম তখন। অতসী নামের মূল তার হৃদয়ে গেঁথে আছে দুবছর ধরে ক্লাস করেও সেটা বোঝা যায়নি। এম, এ ক্লাসে ভর্তি হবার পর ডাকে একদিন অতসী গাঙ্গুলির নামে আধুনিক কবিতার মাসিক-পত্র এলো। কে পাঠালো ভেবে না পেয়ে পাতা উল্টেই দেখে ছাপা অক্ষরে প্রথম কবিতার নামই অতসী। নিচে কবির নাম। বলাবাহুল্য কলেজের সেই অতি চেনা নাম।
বার কয়েক মনোযোগ নিয়ে পড়ে কবিতার মর্মোদ্ধার করা গেছে। চৌ লাইনের মধ্যে পুষ্পবাহার অতসীর বিশেষ একটি মানবী রূপের কল্পনা এবং স্তুতি।
যা করণীয় অতসীর তা ঝটপট করে ফেলা অভ্যাস। তারপর চার লাইনের একটা চিঠির নকলসহ কবিতাটা শেভনাকে দেখিয়েছে। প্রথমে কবিতা এবং পরে চিঠিটা পড়ে শোভনার দুচোখ কপালে।–এই চিঠি সত্যি তুই ভদ্রলোককে পাঠাবি নাকি?
–পাঠাবো না, পাঠিয়ে দিয়েছি।
রুদ্ধশ্বাসে শোভনা চিঠিটা আবার পড়েছে।
কবিতা-পত্র পেলাম। ধন্যবাদ। আপনার অতসী পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। পরের সংখ্যায় কৌটিল্য-ব্যঞ্জনাসহ অর্থশাস্ত্রের ওপর একটি নিটোল সনেট দেখতে পেলে আরো মগ্ধ হব।
–চিঠিতে তোর নাম দিসনি? শোভনার ব্যগ্র প্রশ্ন।
–দেব কেন, কবিতার ওই মাসিক-পত্র যে পাঠিয়েছে সে তার নাম দিয়েছে?
দুজনেই ইকনমিক্স-এর ছাত্রী, অবশ্য বি-এর রেজাল্ট দেখলে শোভনার থেকে অতসী ঢের বেশি এগিয়ে। সেকেন্ড ক্লাস সেকেন্ড হয়েছিল। আত্মীয় পরিজনেরা তাইতেই বেশ খুশি। কেবল অতসীর বুকের ভিতরটা চিনচিন জ্বলছে। মার্কশীটে দেখা গেছে ফার্স্ট ক্লাস ফাস্ট-এর থেকে আট নম্বর মাত্র পিছিয়ে। তার মধ্যে দুদুজন ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে, তারা ছেলে। একজন সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে, সে মেয়ে। অতসী ওদের থেকে নিজেকে কোনো অংশে খাটো ভাবে না। কিন্তু দুদুটো টিউশনি চালিয়ে এর বেশি আর কত হবে। এম. এ-তে ওই তিনজনকেই মনে মনে দেখে নেবার ইচ্ছে। কিন্তু ভিতরের এই জ্বলুনি বা অভিলাষ কাউকেই বুঝতে দেবার মেয়ে নয় সে।
.
যাক। এবারে বন্ধুর উৎসুক প্রশ্ন, কৌটিল্য-ব্যঞ্জনা সহ অর্থশাস্ত্রের ওপর একটি নিটোল সনেট দেখা আর মুগ্ধ হওয়ার অর্থ কি–কলেজের বাংলা মাস্টারের আর্থিক সংগতির খোঁচা দিলি?
অতসীর হাসি এবং জবাব, যা খুশি বুঝে নে বাপু, মনে এলো লিখে দিলাম।
সাদা-মাটা দেখতে শোভনা বিশ্বাস অরসিক বা অনুদার নয়। য়ুনিভার্সিটিতে ঢুকে প্রশংসার ছলে দুই একটি উৎসুক ছেলের কানে অতসী-নামের মহিমা আর মাধুর্য তুলে দিতেই সেটা দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে। দুদুটি তরুণ মাস্টারের মুখে ঝামা ঘষে দেবার ঘটনা শোভনা বিশ্বাস অবশ্যই অনুক্ত রেখেছে। সেটা বলা মানেই প্রকারান্তরে তাদের সতর্ক করা আর সমঝে দেওয়া। এই বোকামো করলে ভবিষ্যতের মজার আশায় জলাঞ্জলি। কলেজের কবি-শিক্ষকের লেখা পুষ্পবাহার অতসীর বর্ণনা আর উপমা কটা কেবল সানুরাগে বন্ধুর ওপর চালিয়ে দিয়ে মন্তব্য করেছে, নামের সঙ্গে এমন মিষ্টি মিল কমই দেখা যায়।
অতসী-ফুল বা গাছ কত ছেলে দেখেছে আর দেখলেও কত জনে মনে রেখেছে। তাতে দুই বন্ধুরই সন্দেহ আছে। দুজনেরই ধারণা এই মিলটুকু ধরিয়ে দেবার পর ছেলেগুলোর কেউ-কেউ আলিপুরের হর্টিকালচারাল গার্ডেনে হানা দিয়েছে। তা না হলে ওই ফুলের গুণগান ছেলে-মেয়েদের (বিশেষ করে ছেলেদের) মুখে মুখে এতটা প্রগলভ হয়ে ওঠে কি করে? ফুলের গুণ-গান বলতে নামের মিলের প্রশস্তি।
এই প্রশস্তির ধারে কাছে না ঘেঁষেও ওই নামের ওপর ছোট্ট একটু কটাক্ষপাত করে ছাত্রবন্ধুদের মজার খোরাক যুগিয়েছিল যে ছেলে তাকে য়ুনিভার্সিটির মধ্যমণি। বললেও অত্যুক্তি হবে না। সমর ঘোষাল। কিন্তু এ প্রসঙ্গ একটু পরে। ছেলেরা সমর ঘোষালকে কেবল ভালবাসে না, অনেক উঁচু পর্যায়ের আত্মজন ভাবে। অতসীর থেকে বছর খানেকের বড় হবে, পড়েও এক ক্লাস ওপরে। সিক্সথ ইয়ারের ছাত্র, সাবজেক্ট ইংরেজি। গত তিন বছরের মধ্যে তার আগে বি, এ-তে ওই বিষয়ে ফার্স্ট ক্লাস অনার্স কেউ পায়নি। সমর ঘোষাল বেশ দাপটের সঙ্গে এই কলঙ্ক মোচন করেছে। এম. এ-তেও ফাস্ট ক্লাস পাবে, এ-ও যেন ধরা-বাঁধা ব্যাপার। ভালো ক্রিকেটার, নামা ক্লাবের এডিভিশনে খেলে, গত বছর থেকে বাংলা দলের বাছাই বারো জনের মধ্যেও জায়গা করে নিতে পেরেছে। মুরুব্বি জনেরা উৎসাহ দেয়, লেগে থেকে সেভাবে চেষ্টা করলে ভারতীয় বাছাই দলেরও সে নিশ্চয় একজন হতে পারবে। এমনিতে চোখের আড়ালেই সরে থাকতে চায়, কিন্তু টেনে এনে সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে অন্য মানুষ। ইংরেজি বাংলা দুই-ই কান পেতে শোনার মতোই বলে। ছাত্র মহলের ইউনিয়নবাজী তথা রেষারেষি অনেকটা এই একজনের জন্যেই অনেক শান্ত এখন। মধ্যস্থতায় নামলে মিটমাট হয়ই। এ হেন গুণের ছেলের সব থেকে বড় গুণ কথা-বার্তায় চাল-চলনে এতটুকু দম্ভ নেই। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, ঠিক সেই রকমই থাকে। যে-যা বলুক মন দিয়ে শোনে, যেন সকলের কাছ থেকেই তার কিছু শেখার আছে। এমনি সব কিছুর ভিতর দিয়ে তার শান্ত সহজ ব্যক্তিত্বটুকুই সকলকে আকর্ষণ করে।