এ পর্যন্ত তাঁর মাল-মশলার নির্ভরে দুটো ছোট গল্প ছাপা হয়েছে। দেখে এবং পড়ে তিনি ছেলেমানুষের মত খুশি। দুবারই বলেছেন, এ থেকে এমন জিনিসও তৈরি হয় মশাই–অ্যাঁ?
কিন্তু যে রমণীটিকে নিয়ে আমার কৌতূহল দানা বেঁধে উঠছে তার সম্পর্কে নিজে থেকে ভদ্রলোক একটি কথাও বলেন না। হীরু দাস যাকে গাড়ি করে নিয়ে আসে আর গাড়ি করে পৌঁছে দেয়। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ এসে গেলে ভদ্রলোক নিজের বিগত স্ত্রীর গল্প করেন, ছেলে-ছেলের বউ বা মেয়ে-জামাই কবে কি কাণ্ড করে বসেছিল সেই গল্প করেন, চাকরি জীবনের কোলিগ আর উপর ওয়ালাদের নিয়ে কত মজার কথাই সিরিয়াস মুখ করে বলেন, তাঁর মেয়ে শমী তো আমার ওপর দারুণ খুশি–তার বাবা মন খুলে গল্প করার মতো একজন মানুষ পেয়েছেন এ নাকি নিজেই মেয়েকে বলেছেন। কিন্তু ওই একটি বিশেষ রমণীর সম্পর্কে ভদ্রলোক এ যাবত একটি কথাও তোলেননি। গাড়ি করে তাকে নিয়ে আসা হয় আর পৌঁছে দেওয়া হয় একারণেই বিশেষ বলছি। হতে পারে বলার মতো কেউ নয়, কিন্তু এমন যদি হয় ইচ্ছে করেই বলেন না তাহলে আমার কৌতূহল অশোভন গোছের হয়ে দাঁড়াবে।
তবু এক একবার মনে হয়েছে জিগ্যেস করে বসি। পারিনি অন্য কারণে। এই একই ব্যাপারে পড়শীদেরও কৌতূহল আমাকে একটু দুর্বল করেছে, সংযমীও করেছে। কেউ চোখ বুজে বসে থাকে না, আর রমণীঘটিত বাতাসের আমেজ সব বয়েসেরই মানুষের গায়ে লাগে বোধহয়। মাসে একবার দুবার ওই রমণীটিকে এই পুলিশ অফিসারের বাড়ি আসতে যেতে আশেপাশের বাড়ির অনেকেই দেখে। যতটুকু সম্ভব লক্ষ্য করে মনে হয়। বিশেষ করে অমর গাঙ্গুলী, আর তার পাশের বাড়ির একতলা দোতলার ভটচায মশাই আর রায়মশাই। মানুষটাকে তাদের দাম্ভিক ভাবাই স্বাভাবিক, কারণ সৌজন্যের দায়েও ভদ্রলোক কারো বাড়িতে পাল্টা দর্শন দিতে যাননি। ব্যতিক্রম কেবল আমি, মুখে সরাসরি না বললেও এটা কারো খুব পছন্দ হয়নি। যাতায়াত করতে দেখেন, একসঙ্গে মর্নিংওয়াক থেকে ফিরতে দেখেন, এমন কি তার মেয়ে-বউয়েরও আমার বাড়িতে আনাগোনা দেখেন। এই সরাসরি না হোক মুখোমুখি বাড়ির দোতলার অমর গাঙ্গুলী ঠেস দিতে ছাড়েন না। সেদিন সন্ধ্যায় আমার এই কোণের ঘরে এসে জাঁকিয়ে বসেছিলেন। প্রথমেই চড়া অভিযোগ, সকাল-সন্ধ্যা আর যে আপনার দেখাই মেলে না, অবসর সময়ের সবটুকুই যে পুলিশ সাহেব নেবারটির দখলে দেখছি!
ছেঁড়া কাপড়ে তাপ্পি লাগানোর মতো করে জবাব দিয়েছি, নিজের স্বার্থে আমি বরং তাঁর অবসরের খানিকটা কাড়তে চেষ্টা করি।
–কি রকম? উৎসুক।–লেখার খোরাক-টোরাক পান নাকি?
–তাছাড়া আর কি, ভদ্রলোকের অনেক অভিজ্ঞতা, খোরাক পেয়ে এরই মধ্যে দুই একটা লেখা ভালো উতরেছে।
জলে বাস করে কুমীরের লেজের ঝাপটা কে না এড়াতে চায়। আমার স্বার্থের এ-দিকটা অমর গাঙ্গুলীর মাথায়ই আসেনি সেটা পরের কথায় বোঝা গেল।–তাই বলুন, আমরা আরো অবাক হচ্ছিলাম পাড়াসুদ্ধ, লোকের মধ্যে কেবল আপনার সঙ্গেই পুলিশ সাহেবের এত ভাব-সাব কেন! উল্টে আপনার ওপরই একটু অভিমান হচ্ছিল, একবারই সেই কার্টসি ভিজিট দিয়ে গিয়ে তার পাশের বাড়ির মানুষটি যে নামী লেখক সে সুখ্যাতি আমরাই করে এসেছিলাম– তার পরেই দেখি কিনা আমে-দুধে মিশে গেল আর আঁঠি, মানে আমরাই বাদ!
আমরা বলতে উনি একা নন। কার্টসি ভিজিট দিতে গেছলেন সঙ্গে আরো দুজন। ওঁর পাশের বাড়ির দোতলার রায়মশাই আর একতলার ভটচায মশাই। পুলিশ সাহেবের এই অবহেলা তাদের চিনচিন করে লাগে এবং আলোচনা হয় বোঝা গেল। প্রসঙ্গ বিরক্তিকর। জবাবে শুধু হাসি।
-তা এই স্বার্থ তো আপনার পেশার অঙ্গ, কিন্তু সাহেবের তো এখন পুলিশের মেজাজ দেখি–আপনার কাছে মুখ খোলেন?
-খোলাতে পারলে খোলেন।
–লেখকদেরই ভাগ্য মশাই–তা আপনাকে বলার স্বার্থ কি, ওঁকে গল্পের হিরো-টিরো বানাচ্ছেন নাকি?
এবার হাসি মুখেই সুর পাল্টালাম।–আপনি, গল্পের অ-আ জানেন না বোঝেন না পড়েন না–কি পেলে আমি কি বানাই আপনাকে কি করে বোঝাই বলুন তো?
নির্বোধ আদৌ নন। হেসে সামলে নিলেন।–তা যা বলেছেন, আদার ব্যাপারীর জাহাজের খোঁজ–আর আপনার এত নাম-যশ কি এমনি এমনি। সঙ্গে সঙ্গে আবার উৎসুক এবং গলা খাটো।–আচ্ছা ও-বাড়ির মেয়ে-বউয়ের সঙ্গেও তো আপনার আলাপ-সালাপ হয়েছে, তারা নিজেদের গাড়িতে আসে যায়–কিন্তু বিকেলের দিকে মাঝে মাঝে পুলিশ সাহেবের গাড়িতে একটি মেয়ে আসে আর সন্ধ্যের পর ওই গাড়িতেই ফেরে–ভটচায মশাই আর রায়মশাইও দেখেছেন– কে বলুন তো মেয়েটি?
জানি না।
সন্দিগ্ধ দু-চোখ আমার মুখের ওপব থমকালে–আপনি তাকে দেখেননি?
–দেখেছি।
–আমরাও দেখেছি, তবে ও-ফুটে গাড়ি থেকে নেমে ভিতরে চলে যায়, আর সন্ধ্যার পর ফেরে তাই ঠিক দেখতেও পাই না, বুঝতেও পারি না
প্রতিবেশীদের আগ্রহ কোন্ পর্যন্ত চলেছে জানার ইচ্ছেয় সাদা মুখ করেই জিগ্যেস করলাম, কি দেখতে বা বুঝতে চান?
-ইয়ে মানে যতটুকু দেখেছি তাতে আত্মীয় বা বড়ঘরের মেয়ে মনে হয় না–অথচ গাড়ি করে নিয়ে আসা হয় দিয়ে আসা হয–তাই ভাবছিলাম কে হতে পারে। আপনার কি ধারণা?
–আমি এ নিয়ে ভাবিও না, কোনো ধারণাও নেই। তবে মেয়েটি ভদ্রলোকের নিজের মেয়ের থেকেও বয়সে ছোট হবে বলে মনে হয়– সে এলে ভক্তিমূলক গান-টান কানে আসে–