চোখ গোল করে আমার দিকে চেয়েছিলেন একটু।–আর ক’জন মানে? আমাকে আপনি ভক্ত ধরে নিয়েছেন?
-নন?
হাসতে লাগলেন।-না মশাই না, ভক্তের বিশ্বাস সম্বল, আমার সেই ঝুলিতে হাজার ফুটো, আমার থেকে হীরু ব্যাটা খাঁটি ভক্ত, তিরিশ বছর বয়সে ওর বউ মরে গেল, ছেলেপুলেও হয়নি, আমার স্ত্রী ঝোলাঝুলি করল আবার বিয়ে কর, ব্যাটা হাত জোড় করে বলে কি জানেন, সব মেয়েকেই ওর এখন মা ভাবতে ইচ্ছে করে, বিয়ে থা আর ওর দ্বারা হবে না। একজন আমাকে বলল, ঘরে দক্ষিণা কালী রাখো, ধূপ ধুনো ফুল জল দাও–ব্যস বাজার ঢুঁড়ে ও এই ছবি এনে এখানে টাঙিয়ে দিলে, রোজ মালা পরিয়ে ফুলজল ধূপধুনো দেওয়া এখন ওর ডিউটির মধ্যে–আমি বাধা দিইনে বলে আমার যেটুকু পুণ্যি।
এ নিয়ে আমি আর তর্কে এগোলাম না। রাশভারী মনিবের অনুমোদন ভিন্ন তার শোবার ঘরে এ-ছবি টাঙিয়ে রোজ ধূপধুনো দেওয়া আর একশ আট জবার মালা পরানো কারো পক্ষেই সম্ভব হত না। হেসে আঙুল তুলে তাকের বই ক’টা দেখালাম।–ওগুলোও হীরই পড়ে বোধ হয়?
আবার হেসে উঠেছেন। তারপর মনে হল তিনি যেন চোখের সামনে কিছু দেখছেন। মৃদু হেসে বললেন, ব্যাপার কি জানেন, মাঝবয়েস পর্যন্ত মনেপ্রাণে আমি পুলিশই ছিলাম, অনেক নিষ্ঠুর কাজ কত অনায়াসে না করেছি।–যে সময়ের কথা বলছি, তখন কর্তাদের অবিবেচনাতেও আমার মন মেজাজ খারাপ, প্রমোশন ডিউ অথচ বছরের পর বছর একটা অজ-জায়গায় পড়ে আছি–সেই সময় একটা ঘটনা আর বিশ্বাসের এক আশ্চর্য নজির দেখে আমার ভিতরে কিরকম নাড়াচাড়া পড়ে গেল।…বুঝলেন, তার পর থেকেই মনে একটা জিজ্ঞাসার উৎপাত শুরু হল। যত ভাবি ততো অথৈ জলে। ওই বইটইগুলো উল্টেপাল্টে দেখি, যারা লিখেছেন তারা তো আর ফেলনা কেউ নন, পড়ে বুঝতে চেষ্টা করি, ভালোও লাগে অস্বীকার করার উপায় নেই, কিন্তু নিজের পায়ের তলায় সেই বিশ্বাসের জমির কোনো হদিসই নেই।…তবে একটু লাভ হয়েছে বলতে পারেন, অন্ধ ভক্তি বিশ্বাস বা আবেগে কাউকে কোথাও মাথা খুড়তে দেখলেও এখন বিজ্ঞের মতো হাসতে পারি না বা অশ্রদ্ধা করতে পারি না।
কান পেতে শুনেছিলাম। কিন্তু লেখকের নাকে রসদের গন্ধ। জিগ্যেস করলাম, যে ঘটনা আর বিশ্বাসের নজির দেখে আপনার এই পরিবর্তন, সেটা কি?
বিমনা ছিলেন, প্রশ্ন শুনে নিজের মধ্যে ফিরলেন আর আঁতকে উঠলেন।–কি সর্বনাশ! আপনার মতলবখানা কি মশাই? এ নিয়ে কলম ধরলে তো গেছি! দাস ফার অ্যাণ্ড নো ফারদার–ওরে হীরু, আর একটু চা-টা দিবি, না কি? মিটিমিটি হেসে মন্তব্য করলেন, পুলিশ অফিসার চাকরি থেকে রিটায়ার করার পরেও তার এক্সহিউমড হবার ভয় থাকে– বুঝলেন।
অর্থাৎ কবর খুঁড়ে মৃতদেহ টেনে তুলে আবার তত্ত্ব-তল্লাশী চলতে পারে।
এড়িয়ে গেলেও আমার মনের তলায় কৌতূহলের আঁচড় পড়ে থাকল।
.
পরের চার মাসের মধ্যে সেই রমণীটিকে আরো পাঁচ ছ’বার দেখলাম। সেই সাদাসিধে বেশবাসের কালো অথচ সুশ্রী দেখতে একজনকে। আমার অনুমানে বয়েস যার আঠাশ তিরিশের মধ্যে। দীর্ঘাঙ্গী, সুঠাম স্বাস্থ্য। হীরু দাস তাকে শেষ বিকেলে বা সন্ধ্যার মুখে কর্তার গাড়ি করে নিয়ে আসে, আবার এক-দেড় ঘণ্টা বাদে গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়ে আসে। তাকে নিয়ে আসা, বাড়ির দরজায় গাড়ি থামিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এসে দরজা খুলে দেওয়া, সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে সিঁড়ির দরজা দিয়ে ঢোকা–এটুকু তৎপরতার মধ্যেও হীরু দাসের চোখে-মুখে বেশ একটু শ্ৰদ্ধার ভাব লক্ষ্য করেছি। সে এলে তাকে এদিকের ঘরে নিশ্চয় বসানো হয় না, তাহলে আমার কোণের ঘর থেকে স্পষ্টই টের পেতাম। ওখান থেকে কেউ জোরে কথা বললেই আমার ঘর থেকে কিছু কিছু শোনা যায়। হলঘরের বসার জায়গায় বসানো হলে সেখান থেকে গানের গলা আর একটু স্পষ্ট ভেসে আসার কথা। আমার ধারণা রমণীটিকে হীরু মালিকের শোবার ঘরে নিয়েই তোলা হয়। কিন্তু খটকা বাধে অন্য কারণে। আমার সামনের বারান্দায় দাঁড়ালে ভদ্রলোকের শোবার ঘর তো এক সারিতেই পড়ে। সেখান থেকে গান তো আরো স্পষ্ট শুনতে পাওয়ার কথা। ঘরের দরজা-টরজা বন্ধ করলে যেমন অস্পষ্ট কিছু কিছু কানে আসে, তেমনি শুনি। তাও গলা চড়ালে। আবার, এলে যে গান হয়ই তা-ও না। পরের পাঁচ ছ’মাসের মধ্যে দিন তিনেক মাত্র গান হচ্ছে বোঝা গেছে। গান হলে কিছু তো কানে আসবেই। ঘন্টা সোয়া ঘণ্টা বাদে তাকে আবার গাড়িতে গিয়ে উঠতে দেখি। গাড়ি চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত অংশুমান ঘোষকে দোতলার রেলিংএ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। হীরু দাস পৌঁছে দেয় কিন্তু ফেরে কখন তা এখন পর্যন্ত টের পেলাম না।
গাড়িটা চলে গেলে ভদ্রলোক এক-আধ দিন ঘুরে আমাকেও বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। মুখ ভালো না দেখা গেলেও রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথাবার্তা হয় না এমন নয়। কিন্তু ওই রমণীকে নিয়ে গাড়িটা চলে গেলেই তিনি সোজা নিজের ঘরে ঢুকে যান।
এক-আধদিন হয়তো বাদ পড়ে, নইলে রোজই ইদানীং একসঙ্গে লেকে মর্নিংওয়াকে যাই, একসঙ্গে ফিরি। আকাশের অবস্থা সুবিধে না বুঝলে তিনি গাড়ি বার করে আমাকে ডেকে নেন, এর ওপর আমি লিখছি না টের পেলে সকালেও ডাক পড়ে, বিকেলে বা সন্ধ্যার দিকে তো মাঝে মাঝেই পড়ে। সকালে গেলে হীরুর হাতের তৈরি গরম সিঙ্গাড়া বা গরম কচুরি জোটে, বিকেলে বা সন্ধ্যায় এক-এক দিন মাংস পরোটাও এসে যায়। খাওয়ার গল্প থেকে তখন অনেক গল্প অনেক কথা হয়। তার চাকরি জীবনের অনেক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা শুনি। তাই থেকে লেখার খোরাক জোটে। জিজ্ঞেস করি –লিখতে পারি না কপিরাইট সিলড? তিনি হেসে মাথা নাড়েন, বলেন সচ্ছন্দে–তবে আমাকে আড়ালে রেখে মশাই।