সে হেসে সত্যি জবাবই দিল, ছাত্র জীবনে পড়তাম, এখন আর খুব সময় পাই না।
তার স্ত্রী অর্থাৎ মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে কটাক্ষপাত। মন্তব্য, এখন ওরা কেবল নাটক বা সিনেমা দেখে আপনার সাহিত্য বিচার করে।
আহত গোছের মুখ করে বললাম, সেটা কি সুবিচার হল?
বছর বত্রিশ হবে মেয়েটির বয়েস, কিন্তু বেশ প্রাণোচ্ছল। বলল, সেটা বোঝে কে। একটা বইয়ের নাম করে বিচারের সরস নমুনা দিল।–বই পড়ে সিনেমাটা আমার ভালো লাগেনি, ওরও না, তাই বইটা লাইব্রেরি থেকে আনিয়ে ওকে পড়তে দিয়েছিলাম। পড়া শেষ করে ও আপনার নায়কের তড়িঘড়ি অমন বাড়িটা করে ফেলার ব্যাপারে খুঁত ধরল, বলল, টেকনিকাল ভুল আছে।
এদের দেখে সত্যি ভালো লেগেছে আর অংশুমান ঘোষ ভদ্রলোকটিকে ভাগ্যবান মনে হয়েছে। যাবার আগে মেয়ে মিনতি করে বলল, আপনি খুব ব্যস্ত জানি, তবু বাবার দিকে একটু চোখ রাখবেন, আপনাকে বাবার খুব ভালো লেগেছে আর আমরাও একজন নামকরা জেঠু পেয়ে গেলাম–বাবা বরাবরই একটু একলা, কিন্তু মা চলে যাবার পর থেকে একেবারে নিঃসঙ্গ, মন খুলে কারো সঙ্গে মিশতেই চান না– আপনি বেড়াতে-টেড়াতে বেরুলে একটু যদি ডেকে নেন খুব ভালো হয়। গলা নিয়ে এখন আবার অসুখ-অসুখ বাতিক হয়েছে, আমি ডাক্তার দেখিয়েছি– কিছুই না।
এরপর একদা জাঁদরেল পুলিশ অফিসার অংশুমান ঘোষের সঙ্গে যত মিশেছি, আমার মনে হয়েছে এ-রকম আরো বিশ-পঁচিশজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে যদি ঘনিষ্ঠ হতে পারতাম, দেশের পুলিশ সম্পর্কেই আমার ধারণা বদলে যেত। সকালে বা বিকেলে আমাকে বারান্দায় ঘুরতে দেখলেই সাদর আহ্বান জানান, হাত খালি নাকি, আসুন না একটু গল্প করি। হয়তো এর দু-আড়াই ঘন্টা আগে দুজনে লেক থেকে মনিংওয়াক সেরে ফিরেছি। যাই। তাঁর সঙ্গ শুধু ভালো লাগে না, এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করি। আগের ভাড়াটের সাত-আট বছরের আমলে বিশেষ কোনো আমন্ত্রণে দুই একবার এসেছি। সামনের এতবড় ডাইনিং-কাম-সিটিং স্পেস মাল আর আসবাবপত্রে এমন বোঝাই থাকত যে পাঁচ মিনিটে হাঁপ ধরে যেত। ছাদে খেতে ওঠার জন্য অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য থাকত না। কিন্তু এখন দোতলায় এসে দাঁড়ালে মনেই হবে না এ সেই একই মস্ত হলঘর। সামনের আধখানাটায় শৌখিন গালচের ওপর দুটো তকতকে সোফা আর একটা সেটি পাতা, মাঝে সুন্দর সেন্টার টেবিল। সোফা সেটির কাঁধ-জোড়া রং-মেলানো চারটে টারকিশ তোয়ালে পাতা। হল-এর মাঝখান দিয়ে দু-মাথা জোড়া সুন্দর পর্দার পার্টিশন। বেশির ভাগ সময় ওটা গোটানোই থাকে। হল-এর ও-মাথায় সুন্দর ডাইনিং টেবিলের চারদিকে ম্যাচ-করা ছ’টা চেয়ার পাল। দুদিকের দেয়ালে একটা করে বড় অয়েল পেন্টিং। তার দুদিকে দুটো করে সাজের বাতির ছোট দেয়াল ঝাড়। দেখলেই বোঝা যায় ওগুলো এ রাজ্যের নয়, বাইরের জিনিস। টিভি এমন জায়গায় পাতা যে বসার জায়গা থেকে আবার খাবার জায়গা থেকেও দেখা যায়। এসে দাঁড়ালে পরিচ্ছন্ন রুচির প্রশংসা করতেই হয়। প্রথম দিন এসে আমার গলা দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, বাঃ!
খুশি হয়ে অংশুমান বলেছিলেন, এতে আমার কোনো কেরামতি নেই মশাই, আমি ঠাসাঠাসি জিনিস পছন্দ করি না জেনে এই হলঘর আর ঘর দুটো সাজানো নিয়ে আমার মেয়ে বউমা আর হীরু মাথা ঘামিয়েছে। সব ঠিক করে আমাকে যখন বলেছে, রেডি, চলো– আমি কষ্ট করে এসে হাজির।
বাইরে নয়, প্রথম দিনই আমাকে নিজের শোবার ঘরে এনে বসিয়েছেন। বলেছেন, অন্তরঙ্গ হতে হলে অন্দরে আসতে হয়, চলে আসুন। শোবার ঘর দুটো রীতিমতো বড় আগেই বাড়ির মেয়েদের মুখে শোনা ছিল। দেখেও খুব ভালো লাগল। এতবড় ঘরখানার বৈশিষ্ট্য সবরকমের বাহুল্য বর্জন। দেয়াল ঘেঁষে খাট পাতা, শৌখিন বেডকভারে ঢাকা। রাস্তার দিকের দরজার পাশে একটা গদি-মোড়া ইজিচেয়ার। খাটের উল্টো দিকের দেয়ালে কালীর মস্ত একখানা বাঁধানো ছবি। তার নিচে দেয়ালে কাঠের তাক ফিট করা। তাতে হাতে-কাজ করা সুন্দর সরু রঙিন কাপড়ের ঢাকনা বিছানো। তাকের দুদিকে দুটো ধূপদানীতে তিনটে করে চন্দন ধূপকাঠি জ্বলছে। মাঝখানে স্টিলের রেকাবিতে কিছু পাঁচমিশেলি ফুল। ফোটোতে একশ আট জবার টাটকা মালা। পরে লক্ষ্য করেছি হীরুর ভোরের বাজারের সঙ্গে এরকম একটা করে জবার মালা রোজই আসে। পাশে আর একটা ছোট্ট দেয়াল-তাকে কিছু বই। কি কি বই দেখলাম। স্বামী বিবেকানন্দর কর্মযোগ, গান্ধীজীর ট্রুথ ইজ গড, সংস্কৃত-বাংলা গীতা একখানা, পাশে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের থিইজম অফ ভগবদগীতা, তার পাশে নিবেদিতার কালী, দি মাদার। শেষে পাঁচ খণ্ডের একসেট কথামৃত।
মন্তব্য করেছিলাম, শাক্ত-বৈষ্ণবের সহাবস্থান ঘটিয়েছেন দেখছি।
চার কোণে চারটে শান্তিনিকেতনী মোড়া। মেয়ে-জামাই আর ছেলে-ছেলের বউয়ের বসার জন্য ওগুলোর ঘরে ঠাঁই হয়েছে বোধহয়। ব্যস, এতবড় ঘরে আর কিছুই নেই। একটা আয়নাও না। মাঝের খোলা দরজা দিয়ে ও-ঘরে স্টিলের আলমারি, ড্রেসিং টেবিল আলনা ইত্যাদি সাজানো দেখা গেল। আমাকে খাটে বসতে দিয়ে নিজে ইজিচেয়ারটা টেনে বসেছেন। এর পরেও যত বার এসেছি, আমি খাটে উনি ইজিচেয়ারে।
প্রথম দিনে দু-দশ কথার পর আমি ইচ্ছে করেই ভক্তি প্রসঙ্গে এসে গেছলাম। জিগ্যেস করেছিলাম, ভক্ত পুলিশ অফিসার আপনি আর ক’জন দেখেছেন?